ভগবান শব্দটির সংজ্ঞা – ভগ; অর্থ ঐশ্বর্য্য এবংবান (বতুপ প্রত্যয় যোগ) ; অর্থ অধিকারী , যার আছে । ঠিক যেভাবে যার সুন্দর রূপ আছে –আমরা তাকে বলি রূপবান, যার ধন আছে ধনবান , ঠিক সেভাবেই যিনি ভগ অর্থাৎ ঐশ্বর্যের অধিকারী তাকে বলে ভগবান ।
“ঐশ্বর্য্যস্য সমগ্রস্য বীর্যস্য যশসঃ শ্রিয়ঃ ।
জ্ঞানবৈরাগ্যয়োশ্চৈব ষন্নত্ ভগ ইতিঙ্গনা “॥
যার মধ্যে এই ছয়টি গুন পূর্ণমাত্রায় বর্তমান, তিনি হচ্ছেন ভগবান – সমস্ত ঐশ্বর্য্য ,সমস্ত বীর্য্য ,সমস্ত যশ ,সমস্ত শ্রী ,সমস্ত জ্ঞান এবং সমস্ত বৈরাগ্য । এই জগতে কেউ বড় ধনী হতে পারে, কিন্তু কেউ দাবী করতে পারেনা আমি সমস্ত ধনের মালিক । এই জগতে কেউ জ্ঞানী হতে পারে ,কিন্তু সে দাবী করতে পারে না সমস্ত জ্ঞানের অধিকারী । কিন্তু ভগবান সমস্ত ধন ,সমস্ত জ্ঞান ,সমস্ত সৌন্দর্য্য ,সমস্ত যশ ,সমস্ত শক্তির অধিকারী, তাই তাকে বলা হয় ভগবান ।
ভগবদগীতাতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বর্ণনা করেছেন আমি সমস্ত কিছুর উৎস ও সবকিছু আমার কাছ থেকে উৎপত্তি হয়েছে । তাই শ্রীকৃষ্ণ কে ভগবান বলা হয়। তিনি অবতার নন। তিনি সাক্ষাৎ ব্রহ্ম। তাই কৃষ ধাতু অর্থাৎ কর্ষণ থেকে যার জন্ম সেই “নন্দের নন্দন কৃষ্ণ মোর প্রাণ নাথ ” ( মালাধর বসু )।
ব্রহ্মসংহিতার পঞ্চম অধ্যায়ের প্রথম শ্লোকেই ব্রহ্মাজী স্বয়ং বলেছেন,
অর্থাৎ সচ্চিদানন্দময় শ্রীকৃষ্ণ, যিনি গোবিন্দ নামে পরিচিত, তিনিই পরম ঈশ্বর, তিনিই অনাদির আদি এবং তিনিই সমস্ত কারণের পরম কারণ।
শ্রীমদ্ভাগবতে (১/৩/২৮) বলা হয়েছে,
অর্থাৎ,শ্রীকৃষ্ণই স্বয়ং ভগবান, সমস্ত অবতারগণ তাঁরই অংশ বা কলা। যুগে যুগে দৈত্য পীড়িত ভুবনকে ইনিই পরিত্রাণের দ্বারা সুখ দিয়ে থাকেন।
অর্থাৎ, শ্রীকৃষ্ণ ঈশ্বর প্রেরিত কোনো দূত বা কোনো অবতার নন বরং তিনি স্বয়ংই ঈশ্বর এবং সমস্ত অবতারগণ তাঁরই অংশ,অর্থাৎ, তিনিই সমস্ত অবতারের অবতারী। এ প্রসঙ্গে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় তিনি নিজেও ঠিক তাই বলেছেন; তিনি বলেছেন (গীতা ১০/২, ১০/৮, ৯/২৪, ৭/৬-৭),
আমিই সমস্ত দেবদেবীদের উৎস, জড় ও চেতন জগতের সবকিছুর উৎস আমিই, সবকিছু আমার থেকেই প্রবর্তিত হয়, আমার উর্ধ্বে কিঞ্চিৎ বস্তুও নেই, আমিই সমস্ত যজ্ঞের ভোক্তা ও প্রভু। যারা আমার চিন্ময়স্বরূপ জানেনা তারা পুন:পুন সংসার সমুদ্রে অধঃপতিত হয়। আমিই নিখিল ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি ও লয়ের কারণ। হে ধনঞ্জয়, আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ পরমার্থ তত্ত্ব আর কিছু নেই।
এরপর ব্রাহ্মসংহিতায় ( ৫/৩৫) ব্রহ্মাজী আরও বলেছেন,
শ্রীকৃষ্ণ স্বরূপত এক তত্ত্ব হয়েও তাঁর অচিন্তশক্তির মাধ্যমে তিনি অনন্ত কোটি ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেন। সমস্ত ব্রহ্মাণ্ড তাঁর মধ্যেই বর্তমান এবং তিনি যুগপৎ সমস্ত ব্রহ্মাণ্ডের পরমাণুতেও পূর্ণরূপে অবস্থিত। সেই অনাদিরাদি গোবিন্দকে আমি ভজনা করি।
তিনি আরও বলেছেন,
প্রভাবশালী এঁরই প্রভা ব্রহ্ম, কোটি কোটি ব্রহ্মাণ্ডে যাঁর ক্ষিতি, অপ, প্রভৃতি বিভূতি পরিব্যাপ্ত এবং যিনি নিষ্কল, অর্থাৎ, অখণ্ড, অনন্ত ও অশেষভূত; সেই অনাদিরাদি গোবিন্দকে আমি ভজনা করি।
অর্থাৎ, উপনিষদে যাঁকে নির্ব্বিশেষ ব্রহ্ম বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে সেই নির্ব্বিশেষ ব্রহ্ম ভগবান শ্রীকৃষ্ণেরই অঙ্গকান্তি। এ প্রসঙ্গে শ্রীমদ্ভাগবতেও ঠিক একই কথা বলা হয়েছে। শ্রীমদ্ভাগবতের দশম স্কন্ধের দ্বাদশ অধ্যায়ের একাদশ শ্লোকে বলা হয়েছে,
ইনিই হচ্ছেন সেই পরম ব্যাক্তি, যাঁকে মহান মুনিঋষিরা নির্ব্বিশেষ ব্রহ্ম বলে জানেন এবং সাধারণ মানুষেরা জড়া প্রকৃতির সৃষ্টি বলেই মনে করেন।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় (১৪/২৭) ভগবান নিজেও বলেছেন যে, তিনিই ব্রহ্মের প্রতিষ্ঠা, এমনকি উপনিষদে ঈশ্বরের যে বিরাট রূপের উল্লেখ রয়েছে, সেই বিরাট রূপের আশ্রয়ও ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং। কারণ, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার একাদশ অধ্যায়ে অর্জুনকে তাঁর বিরাট রূপ দর্শন করিয়েছিলেন। এসব ছাড়াও, অথর্ববেদীয় গোপালতাপনী উপনিষদে (পূর্ব-১৯) বলা হয়েছে,
একমাত্র শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান এবং তিনিই আরাধ্য। তিনি এক হয়েও অনন্ত রূপ ও অবতারের মাধ্যমে প্রকাশিত হন।তাইতো তিনি শ্রীগীতায় বলেছেন-
অনুবাদঃ আমি যখন মনুষ্যরূপে অবতীর্ণ হই, তখন মুর্খেরা আমাকে অবজ্ঞা করে। তারা আমার পরম ভাব সম্বন্ধে অবগত নয় এবং তারা আমাকে সর্বভূতের মহেশ্বর বলে জানে না।
তারপরো যাদের মনে সন্দেহ কৃষ্ণ ভগবান কিনা অথবা গীতায় শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে ভগবান বলেছেন কিনা তারা নিচের রেফারেন্স গুলো দেখে নিতে পারেন-
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন