ভাগবত ও পুরাণ পাঠ

ভাগবত ও পুরাণ পাঠ :গৌর গদাধর সম্প্রদায় (সাটুই , মুর্শিদাবাদ)

Breaking

Post Top Ad

০৫ মার্চ ২০২৪

সনাতন ধর্মে ১০৮ এর গুরুত্বের কারণ

 

অষ্টোত্তর শতনাম হোক কিংবা সূর্য নমস্কার-হিন্দুদের বিভিন্ন প্রথায় ১০৮ সংখ্যাটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত৷ কিন্তু কেন শুধু ১০৮? কেন অন্য কোনও সংখ্যাকে বেছে নেওয়া হল না!

যদি মনে করা হয় শুধু ধর্মীয় কারণে এই সংখ্যা বেছে নেওয়া হয়েছে তাহলে ভুল ব্যাখ্যা হবে৷ কেননা সেটাই একমাত্র কারণ নয়৷ এর সঙ্গে যেমন মিশে আছে বিশ্বাস তেমন জড়িয়ে আছে তখনকার জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের অঙ্কও৷

প্রথমে আসা যাক বিশ্বাসের কথায়৷ বৈদিক তত্ত্ব অনুযায়ী ১০৮ সংখ্যাটি গোটা মহাবিশ্বের প্রতীক৷ অর্থাৎ মহাবিশ্বের অস্তিত্বের প্রমাণ হয় এই সংখ্যাটিতেই৷ আরও বিশ্বাস করা হতো যে, ১০৮টি পবিত্র তীর্থস্থান আছে৷ এছাড়া চারটি বেদ মিলিয়ে মোট উপনিষদের সংখ্যাও ১০৮৷

এখানেই শেষ নয়৷ একসময় বিশ্বাস করা হত, পৃথিবী থেকে চাঁদ ও সূর্যের যা দূরত্ব, তা পৃথিবীর ব্যাসের ১০৮ গুণ৷
Moon’s Diameter : Moon’s Distance from Earth= 1:108 ।
আবার সূর্যের ব্যাস পৃথিবীর ব্যাসের ১০৮ গুন।
Earth’s Diameter:Sun’s Diameter=1:108 ।

এবং তখন যেটি ছিল সবার বিশ্বাস, এটি এখন বিজ্ঞানিদের দ্বারা প্রমাণিত। একইরকমভাবে মনে করা হত, মানুষের পার্থিব দেহের বাইরের অংশ আর অন্তরাত্মার দূরত্ব ১০৮ একক৷

শক্তির প্রতীক দেবাদিদেব মহাদেবের নৃত্যের ভঙ্গি হিসেবে ধরা হয় ভরতনাট্যমকে৷ এই নৃত্যেরও ১০৮টি মুদ্রা রয়েছে৷

দেহতত্বেও এই সংখ্যাটির গুরুত্ব আছে৷ মনে করা হয়, আমাদের শরীরে ১০৮টি বিশেষ জায়গা আছে যেগুলির মধ্যে সংযোগ স্থাপন করা সম্ভব৷ একমাত্র সাধকই তা করতে পারেন৷ এবং এই সংযোগ সাধিত হলে যে কেউ বিশেষ শক্তির অধিকারী হতে পারেন৷ সে কারণেই সূর্যপ্রণাম মন্ত্র বা মালা জপ করার ক্ষেত্রেও ১০৮ সংখ্যাকেই বেছে নেওয়া হয়৷

দুর্গাপুজোতে ১০৮টি পদ্ম লাগে, দেবীর গলায় ১০৮টি বেলপাতার মালা পরানো হয়, নারায়ণ পুজোতে ১০৮টি তুলসী পাতা দেওয়া হয় কিংবা জপের মালাতে ১০৮টি রুদ্রাক্ষ থাকে। বিভিন্ন মন্দিরের সন্ত সমাজে মহামণ্ডলেশ্বরের নামের আগে ‘শ্রী শ্রী ১০৮’ দিয়ে শুরু হয়। সনাতন ধর্ম মতে ১০৮ সংখ্যাটি দ্বারা ব্রহ্মকে প্রকাশ করা হয়, তাই সনাতন ধর্মে ১০৮ সংখ্যাটির এত মাহাত্ম্য।

বাংলা ভাষার বর্ণমালার অক্ষরের সাংখ্যিক স্পন্দন অনুসারে, ব্রহ্ম= ব+র+হ+ম= ২৩+২৭+৩৩+২৫= ১০৮। প্রাচীন সংস্কৃত ভাষায় ৫৪টি অক্ষর ছিল। প্রতিটি বর্ণের পুংলিঙ্গ ও স্ত্রীলিঙ্গ, অর্থাৎ শিব ও শক্তি বর্তমান। সেই অনুযায়ী ৫৪x২= ১০৮। প্রাচীন মুহূর্ত শাস্ত্র অনুসারে, সময়কে ১০৮টি উপলব্ধিতে বিভাজিত করা হয়েছিল। ৩৬ অতীত, ৩৬ বর্তমান, ৩৬ ভবিষ্যৎ। সনাতন ধর্মের পঞ্চদেবদেবী, যাঁরা শাস্ত্রানুসারে সর্বাগ্রে পূজিত (গণেশ, বিষ্ণু, শিব, কৌশিকী বা চণ্ডী এবং সূর্য বা আদিত্য), প্রত্যেকেরই অষ্টোত্তর শতনাম সংকীর্তন করা হয়ে থাকে।

১০৮-কে সংস্কৃতে বলা হয় ‘হর্ষদ সংখ্যা’। কারণ, এই সংখ্যাকে তার সংখ্যা-সমষ্টি দিয়ে বিভাজিত করা যায়। ১+০+৮=৯, আবার ১০৮/৯=১২। আয়ুর্বেদ ও যোগ শাস্ত্রমতে, মানবদেহে মোট ১০৮টি পথ ধরে চালিকাশক্তি এসে হৃদপিণ্ডকে সচল রাখে। কালজয়ী মহাকাব্য মহাভারতে প্রত্যেকটিতেই ১৮টি অধ্যায় আছে। এমনকি শ্রীরামচরিত মানস ৯ দিনে পাঠ সম্পূর্ণ করতে হয়, যাকে ‘নবাহ্ন পরায়ণ’ বলা হয়। নটরাজের তাণ্ডবের থেকে প্রেরিত হয়ে ‘ভরতনাট্যম’-এর সৃষ্টি সেই নৃত্যশাস্ত্রে ১০৮টি হস্ত ও পদ্মমুদ্রা আছে।

ধর্মীয় রীতিতে বৈচিত্র থাকলেও হিন্দু, বৈষ্ণব, বৌদ্ধ, শিখ ও জৈন ধর্মে জপমালার পূঁতির সংখ্যা সর্বক্ষেত্রেই ১০৮। কেন ১০৮টি পুঁতি জপমালাতে থাকে তার একটি সুন্দর ব্যাখ্যা বৌদ্ধ ধর্মে রয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, একটি সূত্র— ৬ x ৩ x ২ x ৩= ১০৮, অর্থাৎ ৬ হল মানুষের ছয়টি ইন্দ্রিয় (চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক ও চিন্তা), ৩ হল ত্রিকাল (অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত্), ২ হৃদয়ের দু’টি অবস্থা (নির্মল ও কলুষিত) এবং ৩ হল মানুষের মনের অবস্থা (ইচ্ছা, অনিচ্ছা ও উদাসীনতা)। জপের মূল উদ্দেশ্য হল ইন্দ্রিয়গুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা, মনের পরিচালনা করা এবং কালের ঊর্ধ্বে নিজের হৃদয়কে প্রতিস্থাপন করা।

বৈদিক যুগের বিশ্বাস, গণিত, বিজ্ঞান, ধর্মীয় প্রথা সব মিলিয়ে মিশিয়েই ১০৮ সংখ্যাটি সনাতন হিন্দুধর্মাবলম্বীদের কাছে আজও পবিত্র হয়ে আছে৷

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Post Top Ad

Your Ad Spot