ভাগবত ও পুরাণ পাঠ

ভাগবত ও পুরাণ পাঠ :গৌর গদাধর সম্প্রদায় (সাটুই , মুর্শিদাবাদ)

Breaking

Post Top Ad

১২ জুলাই ২০২৪

বর্ণাশ্রম প্রথা - চতুর্বর্ণের মধ্যে কে বড়



" চাতুর্বর্নং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ। 

তস্য কর্তারমপি মাং বিদ্ধ্যকর্তারমব্যয়ম।। " 


 অমৃত বেদবানী : - 

ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র সকলে

একে অপরে সমান ভাবে ভালবাস।

                                         যজুর্বেদঃ ১৮/৪৮

আর্যদের সমাজে চারটি বর্ণের মানুষ থাকত। এরা হলেন ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। যারা যাগ যজ্ঞ, পূজার্চনা এবং ধর্ম কর্মে রাজাকে সাহায্য করতেন তাদের বলা হয় ব্রাক্ষ্মণ। যারা দেশ সেবা, দেশ শাসন করতেন তারা ক্ষত্রিয়, যারা ব্যবসা বাণিজ্য, কৃষিকাজ ইত্যাদি করতেন তারা হলেন বৈশ্য। আর এই তিন শ্রেণিকে যারা সেবা করতেন তারা হলেন শূদ্র। ইহাই বর্ণাশ্রম নামে পরিচিত। অবশ্য আর্যরা যখন ভারতে আসেন তখন তারা নিজেদের দেহের আকৃতি ও রং সম্বন্ধে খুবই সচেতন ছিলেন। আর্যরা ছিল গৌরবর্ণ আর এদেশের লােকেরা ছিল কৃষ্ণবর্ণ, এক্ষেত্রে বর্ণ অর্থে রং এবং এই বর্ণ অনুযায়ী আর্যরা নিজেদের স্বতন্ত্র করে নেয়।

ব্রাহ্মণ মানে হচ্ছে বুদ্ধিজীবী সমাজ অর্থাৎ সমাজের মেধাবী শ্রেণি। ক্ষত্রিয় হচ্ছে শাসক শ্রেণি বা যারা রাষ্ট্র পরিচালনার কাজে যুক্ত, বৈশ্য হচ্ছে ব্যবসায়ী বা যারা কৃষি, পশুপালন ও ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। আর শূদ্র হচ্ছে তারা, যারা মেধা, শাসন ক্ষমতা ও ব্যবসা-বাণিজ্য করার সমার্থ না থাকায় অন্য তিনটি বর্ণের লোকদের সেবা প্রদান করে জীবিকা নির্বাহ করে। চারটি বর্ণের বিভাগ, তাদের পরিচিত, স্বভাব ও আচরণ অনুসারে হয়ে থাকে। মানুষের গুণ ও কর্ম দেখে সহজেই বর্ণ নির্ধারণ করা যায়। শাস্ত্রে বর্ণনা অনুসারে চারটি বর্ণ হচ্ছে–
(১) ব্রাক্ষণদের স্বভাব হচ্ছে- “শম. দম (ইন্দ্রিয় দমন), তপস্যা, পবিত্রতা, সন্তোষ, ক্ষমাপরায়ণতা, সহজ প্রকৃতি, ভগবানের প্রতি ভক্তি, ধারণ, দয়া এবং সত্য।
(২) ক্ষত্রিয়দের স্বভাব হচ্ছে, “তেজ, বল, ধৈর্য, শৌর্য, সহিষ্ণুতা, উদারতা, উদ্যমশীলতা, স্থৈর্য, ব্রাহ্মম ভক্তি এবং ঐশ্বর্য।
(৩) বৈশ্যদের স্বভাব হচ্ছে, “ভগবানের প্রতি বিশ্বাস, দানশীলতা, দম্ভরাহিত্য, ব্রাহ্মণসেবা এবং ধন সঞ্চয়ে কখনো সন্তুষ্ট না হওয়া এবং
(৪) শূদ্রদের স্বভাব হচ্ছে, “ব্রাহ্মণ, গাভী এবং দেবতাদের অকপটচিত্তে সেবা করা এবং তাদের সেবার দ্বারা যা পাওয়া যায় ততেই সন্তুষ্ট থাকা। যারা চার বর্ণের বাইরে তাদের কিছু স্বভাব রয়েছে- অপবিত্রতা, মিথ্যাচারিতা, চৌর্য, ঈশ্বর ও পরলোকের অস্বীকৃতি, অনর্থক বিবাদে লিপ্ত হওয়া, কাম, ক্রোধ ও তৃষ্ণার বশীভূত থাকা।
চারটি বর্ণ ও আশ্রম সমূহের সাধারণ কিছু নিয়ম রয়েছে যা সকলেই পালন করতে হয় সেগুলি হচ্ছে “মন, বানী ও শরীর দ্বারা হিংসা না করা, সত্যে অধিষ্ঠিত থাকা, চৌর্য কর্ম না করা, কাম, ক্রোধ, লোভ থেকে বিরত থাকা এবং যে কার্যসমূহে সমস্ত প্রাণিকুলের প্রসন্নতা হয় এবং তাদের মঙ্গল হয় তাই করা।

মানব জীবনকে সুন্দরভাবে ব্যবস্থাপনা করার জন্য মানুষের জীবনকালকে বৈদিক শাস্ত্রে চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যাকে আশ্রম বলা হয়। চারটি আশ্রম হচ্ছে ব্রহ্মচর্য, গৃহস্থ, বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস।
(১) ব্রহ্মচর্য হচ্ছে বিদ্যা অভ্যাসের কাল। যতদিন না বিদ্যা অধ্যায়ন সম্পূর্ণ না হয় ততদিন পর্যন্ত সকল ভোগ থেকে দূরে থেকে বিদ্যা অধ্যায়ন করা উচিত। তারপর বিবাহের মাধ্যমে গৃহস্থ আশ্রমে প্রবেশ করা উচিত।
(২ ) গৃহস্থ আশ্রমে শাস্ত্রোক্ত শ্রীলক্ষণযুক্ত কন্যার সঙ্গে বিবাহ করা উচিত। গৃহস্থ আশ্রমে থেকে ধর্ম অনুসারে আচরণ করা কর্তব্য। তারপর উপযুক্ত পুত্রের হাতে সংসারে দায়িত্ব প্রদান করে বানপ্রস্থ আশ্রম গ্রহণ করতে হয়।
(৩) বানপ্রস্থ আশ্রমে ধর্মের প্রচার এবং শাস্ত্র জ্ঞান লাভের জন্য শাস্ত্র অধ্যায়নের প্রতি মনোনিবেশ করা হয়।
(৪) সন্ন্যাস গ্রহণ করে সংসারের সাথে পূর্ণরূপে সম্পর্ক ছেদ করা হয়। তবে শাস্ত্রে বর্তমান কলি যুগে সন্ন্যাসকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কারণ বর্তমান যুগে যথার্থভাবে সন্ন্যাস আশ্রম পালন করা সম্ভব নয়।

চারটি বর্ণ ও আশ্রম সমূহের সাধারণ কিছু নিয়ম রয়েছে, যা সকলেই পালন করতে হয় সেগুলি হচ্ছে “মন, বানী ও শরীর দ্বারা হিংসা না করা, সত্যে অধিষ্ঠিত থাকা, চৌর্য কর্ম না করা, কাম, ক্রোধ, লোভ থেকে বিরত থাকা। যে কার্যসমূহে সমস্ত প্রাণিকুলের প্রসন্নতা হয়, মঙ্গল হয় তাই করা। বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা অনুসরণের মাধ্যমে সমাজ এবং ব্যক্তি জীবনে অধিক সুখ-শান্তি লাভ করা যায়।কলিযুগে চৈতন্য মহাপ্রভু কর্তৃক প্রবর্তিত যুগধর্ম পালন করলে গৃহস্থ আশ্রমে থেকেই মানুষ মুক্তি লাভ করতে পারে।

চতুর্বর্ণের মধ্যে কে বড় ━আমরা চতুর্বর্ণের মধ্যে কে বড় আর কে ছোট এই বর্ণভেদ করতে করতে একে অপরকে হেয় প্রতিপন্ন করি কিন্তু ভগবান কি বললেন - 

পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গুণ ও কর্মের বিভাগ অনুযায়ী চতুর্বর্ণ অর্থাৎ ব্রাহ্মণ,ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র সৃষ্টি করেছেন। 

"চাতুর্বর্ণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্ম বিভাগশঃ।"

                                                      (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা-৪/১৪) 

অর্থাৎ, "প্রকৃতির তিনটি গুণ ও কর্ম অনুসারে আমি মানব-সমাজে চারিটি বর্ণবিভাগ সৃষ্টি করেছি।" । 

আবার বেদে তিনি বললেন-

        ঋগ্বেদসংহিতাঃ- 

''ব্রাহ্মণো"ঽস্য় মুখমাসীত  বাহূ রাজন্য়ঃ কৃতঃ-

   ঊরূ তদস্য় য়দ্বৈশ্য়ঃ  পদ্ভ্য়াগ্‌ং শূদ্রো অজায়ত ॥"

    তাঁর মুখ থেকে ব্রাহ্মণ, তাঁর বাহু থেকে ক্ষত্রিয়, তাঁর উরু থেকে বৈশ্য এবং তাঁর পা থেকে শূদ্রের জন্ম হয়েছিল। 

     অর্থাৎ ভগবান স্বয়ংই সৃষ্টির সময় বিচার করে দিলেন - যে ব্রাহ্মণ ,ক্ষত্রিয়,বৈশ্য ও শূদ্রের চারপ্রকার গুণই আপনার মধ্যেই  বর্তমান! সেই  সেই গুণ অনুযায়ীই আপনি আপনার কর্ম নির্ধারণ করতে পারেন! 

   ভগবান  মস্তক থেকে ব্রাহ্মণের সৃষ্টি করলেন , অর্থাৎ আপনি আপনার নিজস্ব গুণ অনুযায়ী আপনার মুখ যখন শাস্ত্র কথা বলবে এবং এই সমাজের প্রত্যেক মানুষের আধ্যাত্মিক কল্যাণসাধন করে, জড়-জগতের বন্ধন থেকে মুক্তিলাভের পথ প্রদর্শন করাবে, বিনিময়ে আপনি দক্ষিণা গ্রহণ করবেন, তখন আপনি ব্রাহ্মণ। 

  ভগবান  বাহুযুগল থেকে ক্ষত্রিয়ের সৃষ্টি করলেন, অর্থাৎ, আপনার বাহুযুগল যখনই সমাজ ও দেশকে, দেশের আইনকে রক্ষার জন্য শক্তিসম্পন্ন হবে, অস্ত্র ধারণ করবে, বিনিময়ে আপনি কর গ্রহণ করবেন তখনই আপনি ক্ষত্রিয়! 

     আবার ভগবানের ঊরুযুগল থেকে বৈশ্যের সৃষ্টি অর্থাৎ এই সমাজটা দাঁড়িয়ে রয়েছে আপনার হাঁটুর উপরের অংশের উপর অর্থাৎ ব্যবসা বানিজ্যের উপর, সুতরাং এই সমাজকে রক্ষা করতে  আপনি যখন ব্যবসা বাণিজ্য করে তার লভ্যাংশ গ্রহণ করবেন তখনই আপনি বৈশ্য! 

     আবার ব্রাহ্মণ হিসাবে জ্ঞান প্রদান করতে হোক, অথবা ক্ষত্রিয় হিসাবে সমাজ দেশকে রক্ষা করতে হোক, কিম্বা বৈশ্য হিসাবে ব্যবসা বানিজ্যে রক্ষা করতে হোক, এই পুরো শরীরটা দাঁড়িয়ে রয়েছে পায়ের উপর এবং এক জায়গা থেকে আর আর একজায় গমন করতে হয়ে পায়ের প্রয়োজন! তাই ভগবান চরণযুগলকে বৈশ্যের সঙ্গে তুলণা করলেন এবং চরণযুগল থেকেই গুণ অনুযায়ী বৈশ্যের সৃষ্টি করলেন! ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্যের কর্ম্ম সম্পাদনের জন্য যখন আপনি খাদ্য উৎপাদন, গোপালন, অস্ত্রশস্ত্র প্রস্তুত ইত্যাদি কর্ম করবেন, বিনিময়ে আপনি মাইনে গ্রহণ করবেন তখনই আপনি শূদ্র। 

   সুতরাং আপনার শরীরে প্রত্যেকটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ একে অপরের পরিপূরকরূপে সহায়ক, আপনি কোনও অঙ্গকে ছোট বড় মনে করে একটা বাদ দিতে পারবেন না! একটা বাদ দিলে বাকি তিনটে অচল হয়ে যাবে! অর্থাৎ আপনার শরীরের মধ্যেই রয়েছে চার বর্ণ! আপনি কাউকে বড় ছোট বলে প্রতিপন্ন করতে পারবেন না! তেমনি সমাজে যে যেমন কর্ম করুক সবাই একে অপরের উপর নির্ভরশীল এবং কর্ম ও গুণ অনুযায়ী প্রত্যেকে সেই সেই স্তরে রয়েছেন, কিন্তু কেউই বড়ো কিম্বা ছোট নয়, সবাই সমান! কারণ আপনার মধ্যেই ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রের চারপ্রকার গুণই একই সাথে থাকতে পারে, এবং স্থান, কাল ও পরিস্থিতি অনুযায়ী আপনি তেমন তেমন কর্ম করতেও আপনি সক্ষম! সুতরাং আপনিই ব্রাহ্মণ, আপনিই ক্ষত্রিয়, আপনিই বৈশ্য এবং আপনিই শূদ্র । শুধুমাত্র সময় ও পরিস্থিতি অনুযায়ী গুণ ও কর্ম পরিবর্তন হতে পারে। মনে রাখবেন ,মা গঙ্গা  কিন্তু ভগবানের শ্রী চরণ থেকেই উৎপন্ন হয়েছে অতএব কর্ম তোমার স্থান নিদৃষ্ট করবে। 

একনজরে :- বর্ণাশ্রম প্রথা কী?

বর্ণ- স্বাভাবিকভাবে সমাজে চারটি ভাগে বিভক্ত। সেগুলাে হলঃ
✼ ব্রাহ্মণ- বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন শ্রেণী।
✼ ক্ষত্রিয়- শাসক শ্রেণী।
✼ বৈশ্য- ব্যবসায়িক শ্রেণী।
✼ শুদ্র- শ্রমিক শ্রেণী।

🌱 আশ্রম-সমাজে মানুষ চার প্রকারে অবস্থান করেন। যেগুলাে হলঃ
✼ ব্রহ্মচর্য- কৌমার্য জীবন।
✼ গৃহস্থ- বিবাহিত জীবন।
✼ বানপ্রস্থ- অবসর জীবন।
✼ সন্ন্যাস- জীবনে ত্যাগের স্তর।

🌱 চারটি বর্ণের গুণগুলাে কী কী?

✼ ব্রাহ্মণঃ শান্তি, আত্ম-সংযম, সংযম, পবিত্রতা, ধৈৰ্য্য, সততা, জ্ঞান, প্রজ্ঞা এবং ধার্মিকতা।
✼ ক্ষত্রিয়ঃ শৌর্য, বীর্য, দূঢ়তা, সম্পদশালী, সাহসিকতা উদারতা এবং নেতৃত্ব।
✼ বৈশ্যঃ কৃষি, গাভীর সুরক্ষা এবং ব্যবসা।
✼ শুদ্রঃ অন্যদের সেবা করা এবং শ্রম দেওয়া।🌱

      



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Post Top Ad

Your Ad Spot