ভাগবত ও পুরাণ পাঠ

ভাগবত ও পুরাণ পাঠ :গৌর গদাধর সম্প্রদায় (সাটুই , মুর্শিদাবাদ)

Breaking

Post Top Ad

০৯ জুলাই ২০২৪

গুপ্তিপাড়া রথযাত্রা -

 গুপ্তিপাড়া রথযাত্রা - 

রথ বলতেই আমাদের উড়িশ্যার পুরী ধাম এর কথা মনে এলেও আমাদের বাংলা রথযাত্রায় কোন অংশেই পিছিয়ে নেই। শ্রীরামপুব় এর মাহেশ হোক, মেদিনীপুর এর মহিষাদল হোক, মায়াপুর এর ইস্কন হোক, অথবা গুপ্তিপারা কেউ কোন অংশে কম নয়।সব জায়গাতেই অতি সুপ্রাচীন রথ যাত্রা পালিত হয়।

ইতিহাস :- 
১৭৬০ সালে বাংলার প্রথম বারোয়ারি পুজার প্রচলন গুপ্তিপাড়ায়,এটি বিন্ধ্যবাসিনী জগদ্ধাত্রী পুজা নামে প্রচলিত। কিন্তু গুপ্তিপাড়ায় রথ এর প্রচলন আরো আগে।যতদূর জানা যায় ১৭৪০ খ্রী মহারাজা কৃষ্ণ চন্দ্রের সময় এই রথ যাত্রা সূচনা করেন শ্রী মধুসূদানন্দ মহারাজ।পুরীর রথের সাথে গুপ্তিপাড়ার রথের প্রধান পার্থক্য হলো পুরীর রথ কে জগন্নাথ দেব এর রথ বলা হয়, কিন্তু গুপ্তিপাড়ার রথ বৃন্দাবন জিউ এর রথ নামে পরিচিত।পুরীর পর সবচেয়ে বেশি দূরত্বের পথ অতিক্রম করে এই গুপ্তিপাড়ার রথ।বছরের বাকি সময় বৃন্দাবন চন্দ্রের মঠ এর পাশে এই রথ অবস্থান করে ।রথযাত্রার দিন বৃন্দাবন চন্দ্রের মঠ থেকে জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা কে দেড় কিলোমিটার দূরে গোঁসাই গঞ্জ বড়বাজার এ মাসীর বাড়ি বা গুন্ডিজা মন্দিরে নিয়ে আসা হয়।

প্রেক্ষাপট  : - কথিত আছে লক্ষ্মীর সঙ্গে মন কষাকষি হওয়ায় জগন্নাথ লুকিয়ে মাটিতে এসে আশ্রয় নেয়। সেখানে ভাল ভাল খাবার পেয়ে জগন্নাথ মাসির বাড়িতেই থেকে যান। অন্যদিকে লক্ষ্মীর মনে সন্দেহ দানা বাঁধে যে স্বামী বোধহয় পরকীয়ার টানে কোথাও চলে গিয়েছেন। পরে তিনি বৃন্দাবনের কাছে জানতে পারেন যে জগন্নাথ মাসির বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। তারপরেই স্বামীকে ফিরিয়ে আনতে লক্ষ্মী লুকিয়ে গিয়ে মাসির বাড়িতে সর্ষে পােড়া ছিটিয়ে আছে। কিন্তু, তাতে কোনো কাজ না হওয়ায় বৃন্দাবন ও কৃষ্ণচন্দ্র লোকজন নিয়ে মাসির বাড়িতে হাজির হন।

সেখানে গিয়ে তারা দেখেন যে ঘরের তিনটি দরজা বন্ধ। তাই লক্ষ্মীর অনুরোধে তার স্বামীকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য দরজা ভেঙে বৃন্দাবন ও কৃষ্ণচন্দ্র ভেতরে ঢােকেন। ঘরের ভেতরে প্রবেশ করেই তারা দেখতে পান মালসায় করে রকমারি পদের খাবার সাজানাে রয়েছে। ভাল ভাল খাবার চোখের সামনে দেখে তারা সেই সমস্ত মালসা লুট করে নেন। যা ভাণ্ডার লুট নামে সকলের কাছে পরিচিত।

আবার আরেকটি অংশ দাবি, বৃন্দাবন চন্দ্র প্রচুর ধনসম্পত্তি ছিল। রাজা তার রাজ্যের শক্তিমানদের চিহ্নিত করার জন্য এই ভান্ডার লুটের আয়োজন করেছেন। যারা বেশি সংখ্যায় ভাণ্ডার লুট করে তাদের বৃন্দাবন চন্দ্র তার মন্দির পাহারার দায়িত্বে নিয়ােগ করতেন।

তবে প্রথা চালুর কারণ নিয়ে দ্বিমত থাকলেও প্রাচীন সেই রীতি মেনে এখনও প্রতিবছর উল্টোরথের আগের দিন মাসির বাড়ির মন্দিরের তিনটি দরজা একসঙ্গে খেলা হয়। ঘরের ভিতর রকমারি খাবারের পদ মালসায় করে সাজানো থাকে। দরজা খেলার পর এই প্রসাদ নেওয়ার জন্য মানুষের মধ্যে হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে যায়। এই মালসা ভোগ পাওয়ার জন্য দূরদূরান্ত করে কয়েক হাজার মানুষ উল্টোরথের আগের দিন প্রসাদ পাওয়ার জন্য গুপ্তিপাড়া হাজির হন।

ভোগ : - ভান্ডার লুটের জন্য গোবিন্দভোগ চালের খিচুড়ি, বেগুন ভাজা, কুমড়ো ভাজা, ছানার রসা, পায়েস, ক্ষীর, ফ্রায়েড রাইস, মালপোয়া, সন্দেশ, ও রাবড়ি সহ মোট ৫২টি পদে খাবার সহ প্রায় ৫৫০ টি মালসা তৈরি করা হচ্ছে। প্রতিটি মালসা প্রায় ৫ থেকে ৮ কেজি করে খাবার থাকে। এই কর্ম যজ্ঞের জন্য ১০ জন রাঁধুনি ও ১০ জন হেল্পার সহ মােট ২০ জন রান্নার কাজ করেন। নিয়ম মেনে দুপুর দুটোর আগেই সমস্ত খাবার তৈরি করে মালসায় সাজিয়ে মাসির বাড়িতে রাখা হয়। বিকেল ৩ টায় মাসির বাড়ির দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়।


আকৃতি :- 
গুপ্তিপাড়ার বিখ্যাত রথ নির্মিত হয়েছে নবরত্ন মন্দির এর আদলে।যেখানে আমরা মোট নটি চুড়া দেখি।বর্গাকৃতির রথটির দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ সমান, ৩৪ ফুট।চারতলা বিশিষ্ট এই রথ এর উচ্চতা ৩৬ ফুট।রথে সর্বমোট ১৬ টি চাকা আছে।রথ এর সামনে থাকে ৪ টি রশি, প্রতিটি রশি প্রায় ৩০০ ফুট দৈর্ঘ্যের।রথ এর পেছনে দেখা যায় ওপর একটি রশি , যা রথকে থামাতে সাহায্য করে।সামনে এই রসিগুলির একটি মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত।

বাংলার ঐতিহ্যশালী ও বড় রথগুলির মধ্যে গুপ্তিপাড়ার এই রথ এর যথেষ্ট সুনাম। ৪০০ বছরের প্রাচীন বৃন্দাবনচন্দ্রের রথযাত্রা শুরু হয় রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সময়ে। মেলা উপলক্ষে বৃন্দাবন মঠের সামনে থেকে বাজার পর্যন্ত দীর্ঘ ১ কিমি পথের দু ধারে মেলা বসে। এছাড়া উল্টোরথের আগের দিন ‘ভাণ্ডারলুট’ উৎসব ধুমধামের সাথে পালিত হয়।

গুপ্তিপাড়ায় রাজা রামমোহন রায়ের সঙ্গীত শিক্ষাগুরু ‘কালী মির্জা’র জন্ম। এছাড়া বিখ্যাত কবিয়াল ভোলা ময়রা, বিজ্ঞানী ইন্দুমাধব মল্লিক ও নবাব সিরাজউদ্দৌলার সেনাপতি মোহন লালের জন্মস্থান। বাংলার মিষ্টি গুঁপো সন্দেশ উদ্ভব হয় গুপ্তিপাড়াতে।সব মিলিয়ে ঐতিহ্যমন্ডিত এই রথ সত্যি সবার মনে ভক্তিরস সঞ্চার করে।


পথনির্দেশ : - 
গুপ্তিপাড়ার দূরত্ব হাওড়া (কাটোয়া লোকাল) থেকে রেলপথে ৭৫ কিলোমিটার ও ব্যান্ডেল থেকে ৩৫ কিলোমিটার। আসাম রোড দ্বারা সড়কপথে এই জায়গাটি কলকাতার সাথে যুক্ত। গঙ্গার অপর তীরে নদিয়া জেলার শান্তিপুরের সাথে জলপথে যোগাযোগ আছে। হাওড়া ও শিয়ালদা থেকে কাটোয়া লোকাল ধরে সরাসরি পৌঁছোন যায় গুপ্তিপাড়া।এছাড়া ট্রেন এ ব্যান্ডেল পৌঁছে সেখান থেকে লোকাল ট্রেনে গুপ্তিপাড়া আসতে পারেন। হাওড়া থেকে গুপ্তিপাড়ার দূরত্ব মাত্র ৭৫ কিলোমিটার।এছাড়া প্রাইভেট গাড়িতে 
জি . টি / দিল্লী রোড ধরে এসে ৬ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে গুপ্তিপাড়ার রথতলা মোড়ে আসতে পারেন।শুধু মাত্র রথযাত্রা নয়, গুপ্তিপাড়ার মন্দির নগরী হিসেবে খ্যাতি আছে।






কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Post Top Ad

Your Ad Spot