ভাগবত ও পুরাণ পাঠ

ভাগবত ও পুরাণ পাঠ :গৌর গদাধর সম্প্রদায় (সাটুই , মুর্শিদাবাদ)

Breaking

Post Top Ad

১০ আগস্ট ২০২৪

ঝুলন পূর্ণিমা , ঝুলন যাত্রা


“অনুগ্রহায় ভূতানাং মানুষং দেহমাশ্রিতঃ।
ভজতে তাদৃশীঃ ক্রীড়াঃ যাঃ শ্রুত্বা তৎপরো ভবেৎ।।”

লীলার কারন সম্বন্ধে শাস্ত্রে বলছে – ভগবানের এই দিব্যলীলার আনন্দ মাধুরী শ্রবন করে ভক্তগণ দিব্য ও অমৃত ভক্তি লাভ করবে। বিষয়ভোগে মত্ত মানবের মনে শ্রীভগবানের অপার লীলা শ্রবনের পর শুদ্ধ ভক্তি জন্মাবে এবং সে ভগবানের শ্রীচরণে মনোনিবেশ করবে। ভগবান গোবিন্দের নিত্য অষ্টকালীন লীলা গুলি হল - ‘নিশান্ত’, ‘প্রাতঃ’, ‘পূর্বাহ্ণ’, ‘মধ্যাহ্ন’, ‘অপরাহ্ণ’, ‘সায়াহ্ন’, ‘প্রদোষ’ ও ‘নক্ত’। এই লীলাগুলির মধ্যে একটি ‘দিব্যলীলা’ হল ‘ঝুলন যাত্রা’। ঝুলন শব্দের সাথে ‘দোলনা’ শব্দটিই ফুটে ওঠে। ভগবান মধুসূদনের এই দিব্যলীলার কথা স্মরণ করে ভক্তেরা তাই শ্রীরাধামাধব সুন্দরকে দোলনা তে বসিয়ে পূজো করেন। ভক্তের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় শ্রীভগবানের ঝুলন লীলার অপূর্ব সঙ্গীত -
“গগনে কৃষ্ণ মেঘ দোলে –
কিশোর কৃষ্ণ দোলে বৃন্দাবনে।
থির সৌদামিনী রাধিকা দোলে নবীন
ঘনশ্যাম সনে।।
দোলে রাধা শ্যাম ঝুলন-দোলায়
দোলে আজি শাওনে।।
পরি’ ধানি রঙ ঘাঘরি, মেঘ রঙ ওড়না
গাহে গান, দেয় দোল গোপীকা চল-চরণা,
ময়ূর নাচে পেখম খুলি’ বন-ভবনে।।
গুরু গম্ভীর মেঘ-মৃদঙ্গ বাজে আঁধার
অশ্রুর তলে,হেরিছে র্রজের রসলীলা অরুন লুকায়ে মেঘ-কোলে।
মুঠি মুঠি বৃষ্টির ফুল ছুঁড়ে হাসে
দেব-কুমারীরা হেরে অদূর আকাশে,
জড়াজড়ি করি’ নাচে, তরুলতা উতলা পবনে।।”


ঝুলনযাত্রা বা লীলা বর্ষার লীলা। ঝুলন পূর্ণিমাকে শ্রাবণী পূর্ণিমাও বলা হয়।বৃন্দাবনে রাধা-কৃষ্ণর শৈশব-স্মৃতি, বিশেষতঃ সখা-সখীদের সাথে দোলনায় দোলার প্রেমলীলাকে কেন্দ্র করে দ্বাপরযুগে এই ঝুলন উৎসবের সূচনা হয়েছিল। এর পর থেকে এখনো গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের এটা প্রিয় অনুষ্ঠান। ঝুলন পূর্ণিমাকে শ্রাবণী পূর্ণিমাও বলা হয়। 

ঝুলনযাত্রা বহুযুগ আগে থেকে ব্রজভূমি বৃন্দাবনে মহাসমারোহে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে, শ্রীকৃষ্ণ এবং শ্রীরাধিকা তাঁদের ‘অষ্টসখী’ - ‘ইন্দুরেখা’, ‘চিত্রা’, ‘চম্পকলতা’, ‘ললিতা’, ‘বিশাখা’, ‘তুঙ্গবিদ্যা’, ‘সুদেবী’ এবং ‘রঙ্গদেবী’র সাথে লীলা করেছিলেন ঐ দিনে। ঝুলনের অপর নাম ‘হিন্দোলনলীলা’। ব্রজবাসীরা এই সময় কদমগাছে ঝুলা (দোলনা) বেঁধে রাধাকৃষ্ণকে দোল খাওয়ান।

রাধা কৃষ্ণের ঝুলনযাত্রা অনুষ্ঠানটি কবে কোনো সময়ে সর্ব প্রথম আরম্ভ করা হয়েছিল, সেটা জানা নেই,তবে শাস্ত্র ধারণা মতে, এ অনুষ্ঠানটি খুব সম্ভবতঃ খ্রীস্টপূর্ব ‘এগারো দশকে’ দ্বাপর যুগে আরম্ভ হয়েছিল, গোপালকে দোলনায় তুলে মা যশোদা ঝোলাতেন। পরবর্তীতে কৃষ্ণের সঙ্গী সাথীরা গরু চরানোর সময় জঙ্গলের বড় বড় গাছের ডাল থেকে ঝুলানো ঝুলনায় কৃষ্ণকে বসিয়ে খেলা করতেন। আবার কখনো কৃষ্ণকে নিয়ে গোপ সখা সখিরা সুন্দর সুন্দর ফুল পুষ্পমালা দিয়ে দোলনা সাজিয়ে ঝুলনার আনন্দ উপভোগ করতেন।


শাস্ত্র মতে ‘রাধা’ হচ্ছেন ‘কৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি মহামায়া’। রাধা হচ্ছেন ‘কৃষ্ণ ভক্ত শিরোমনি’। কৃষ্ণ শক্তিতে, কৃষ্ণপ্রেমে তিনি আরাধিতা ও বলিয়ান তাই তো তিনি রাধা। তাকে বলা হয় জীবজগতের প্রতীকী স্বত্বা, কৃষ্ণ ভক্তের আরাধ্য দেবী। শ্রীকৃষ্ণের প্রেমভক্তিতে তিনি বলিয়ান তাই রাধা রানীর কৃপা হলে অতি সহজেই কৃষ্ণ কৃপা হয়। আবার রাধা শক্তিতে কৃষ্ণ শক্তিশালী তাই তো তাঁরা উভয় মিলে এক ও অভিন্ন।

বৈষ্ণবদের একটি জনপ্রিয় উৎসব হল ঝুলন। শ্রাবন মাসের শুক্লা একাদশী থেকে রাখীপূর্ণিমা পর্যন্ত পাঁচদিন ঝুলন উৎসব পালন করা হয়। হোলি ও জন্মাষ্ঠমীর মতই ঝুলন উৎসবও ধুমধাম করে পালন করে বৈষ্ণবসহ গোটা সনাতন ধর্মালম্বীরা। ঝুলন পূর্ণিমাকে শ্রাবন পূর্ণিমাও বলা হয়ে থাকে। বৃন্দাবনে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমকে কেন্দ্র করে দাপর যুগে ঝুলন উৎসব শুরু হয়েছিল। তখন থেকে যুগ যুগ ধরে ঝুলন উৎসব পালিত হয়ে আসছে। ঝুলন-যাত্রায় অংশগ্রহণ করতে পৃথিবীর নানা জায়গা থেকে মানুষ পশ্চিমবঙ্গের নবদ্বীপ, মায়াপুর, শান্তিপুরে ছুটে আসেন। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর জন্মস্থান নবদ্বীপ এবং বিশেষত মায়াপুরে যেরকমভাবে এই ঝুলন উৎসব পালিত হয় তা পশ্চিমবঙ্গের অন্য কোথাও বিশেষ দেখা যায় না। কিন্তু জানেন কি কেন পালন করা হয় ঝুলন উৎসব? আসুন সেই ঘটনাটা জানা যাক...

শ্রাবণ মাসে যখন কদম গাছে ফুল ফোটে, বৃষ্টি পড়ে, ময়ূর পেখম মেলে নেচে ওঠে, তখন রাধা-কৃষ্ণের সখীদের ইচ্ছে হয় রাধা-কৃষ্ণকে একসাথে দোলনায় বসিয়ে, সুন্দর ভাবে ফুল দিয়ে সাজিয়ে দোলনা বসিয়ে দোলানোর। তাই ঝুলনে রাধা-কৃষ্ণকে দোলনায় বসিয়ে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে দোলানো হয়। তারপর রাধা-কৃষ্ণের পূজা করা হয়।  শাস্ত্রমতে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমকে সম্মান দিতে ঝুলন উৎসব পালন করা হয়।  বৃন্দাবনে রাধা ও সখীদের নিয়ে যে লীলা করতেন কৃষ্ণ, তারই কৃত্রিম রূপ দিতে পালন করা হয় ঝুলন। শাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণের মোট বারোটি যাত্রার কথা উল্লেখ আছে। এর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ হল - রথযাত্রা, রাসযাত্রা, দোলযাত্রা, স্নানযাত্রা ও ঝুলনযাত্রা।  এক এক অঞ্চলে দোল বা দুর্গোৎসবের মতো সাড়ম্বরে পালন হয়। ঝুলনেও দেখা যায় নানা আচার অনুষ্ঠান ও সাবেক প্রথা। এই উৎসব হয় মূলত বনেদিবাড়ি এবং মঠ-মন্দিরে। এর পাশাপাশি এই উৎসবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ঐহিত্য। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের সঙ্গেই ছোটদের ঝুলন সাজানোর আকর্ষণও কিছু কম নয়।কৃষ্ণের বাল্যকাল থেকে কিশোর বয়স পর্যন্ত নানা কার্যকলাপ পুতুল দিয়ে সাজানো হয়ে থাকে যা ঝুলনের বিশেষ আকর্ষণ। ভক্তেরা বিশ্বাস করে এই ঝুলন উৎসবে রাধা-কৃষ্ণকে দোলনায় দোলালে কৃষ্ণ বেশি খুশি হয়ে থাকেন।শ্রীকৃষ্ণের আরেক নাম পীতাম্বরধারী। ঝুলনযাত্রার দিন শ্রীকৃষ্ণকে হলুদ রঙের বস্ত্র পরান। এছাড়া ওই দিন হলুদ মিষ্টি, হলুদ রঙের ফল ও ফুল দিয়ে শ্রীকৃষ্ণের পুজো। নানা ধরনের মাটির পুতুল, ময়ূরের পালক , কাঠের দোলনা আর গাছপালা দিয়ে ঝুলন সাজানো হয়ে থাকে। কোথাও কোথাও ঝুলন উপলক্ষে চলে নামসংকীর্তন। এই সময় প্রতিদিন ২৫-৩০ রকমের ফলের নৈবেদ্য, লুচি, সুজি নিবেদন করা হয় রাধা-কৃষ্ণকে।

ভারতের সমস্ত স্থানের মধ্যে মথুরা, বৃন্দাবন, পুরী, মায়াপুর ঝুলন যাত্রা উদযাপনের জন্য সবচেয়ে বিখ্যাত। সারা বিশ্ব থেকে হাজার হাজার কৃষ্ণ ভক্ত পবিত্র শহর মথুরা, বৃন্দাবন, উড়িষ্যার পুরী এবং পশ্চিমবঙ্গের মায়াপুরে আসন। রাধা এবং কৃষ্ণের মূর্তিগুলিকে বেদী থেকে সরানো হয় এবং ভারী অলঙ্কৃত দোলনায় স্থাপন করা হয়। সকল ভক্তরা প্রভুর প্রেমে মগ্ন হন। বৃন্দাবনের শ্রী রূপ-সনাতন গৌড়ীয় মঠ, বাঁকে বিহারী মন্দির এবং রাধা-রমণ মন্দির, মথুরার দ্বারকাধীশ মন্দির, জগন্নাথ পুরীর গৌড়ীয় মঠ, ইসকন মন্দির, গোবর্ধন পীঠ, শ্রী রাধা কান্ত মঠ, শ্রী জগন্নাথ বল্লভ মঠ এবং ইসকন প্রভৃতি জায়গা যেখানে এই উৎসব তাদের সবচেয়ে বড় জাঁকজমকের সঙ্গে পালিত হয়। পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে নদীয়ার শান্তিপুরে, বরানগরের পাঠবাড়ি আশ্রমে, বউবাজারের বিখ্যাত রামকানাই অধিকারীর ঝুলনবাড়িতে ঝুলন যাত্রার উৎসব দেখার জন্য বহু দর্শক সমাগম হয়।

রাজাও নেই রাজত্বও গিয়েছে। তবু ফিকে ঝাড়বাতিতে টিমটিমিয়ে ঝুলন সাজাচ্ছে রাজবাড়ির মন্দিরগুলি।


এখনও শহরের ‘জহুরিপট্টি’তে ‘বর্ধমান রাজবাড়ির লক্ষীনারায়ণ জিউ মন্দির’, ‘নতুনগঞ্জের রাধাবল্লভ জিউ মন্দির’ কিংবা ‘শ্যামসুন্দর মন্দির’ পাঁচ দিনের ঝুলনযাত্রার আয়োজন করে। পূজো, আরতির পাশাপাশি কোথাও বাউল গান কোথাও লোকসঙ্গীত কোথাও আবার রামায়নী গানের আসর বসে। তবে উদ্যোক্তা এবং অর্থের অভাবে রাতভর ব্যাপী যাত্রা, পালাগানের আসর কিংবা তরজা গানের আসর বসাতে পারে না মন্দির কমিটিগুলি। পুরনো দিনের স্মৃতিচারণাই তখন ভরসা তাঁদের।
জানা যায় যে, আগে লক্ষীনারায়ণ জিউ মন্দিরকে সাতটি কাঠরায় (খুপরি) ভাগ করে কোনওটিতে কৃষ্ণ পদসেবা চিত্র, কোনওটিতে নৌকোবিলাস, কালিয়াদমন, নরনারী কুঞ্জ ইত্যাদি সাজানো হত। বাহারি সাজে রাধাকৃষ্ণের মূর্তির সঙ্গে বিদ্যুতের রোশনাইয়ের খেলায় জমকালো ছিল ঝুলনের সেই সন্ধ্যাগুলি। রাতের দিকে বসতো কবিগান, তরজা গানের আসর। অ্যামেচার পার্টির যাত্রাও হতো। এখন অবশ্য সেই জৌলুসের কিছুই অবশিষ্ট নেই। তখন রাজকোষ থেকে বর্ধমানের ছোটো রাজকুমার লক্ষাধিক টাকা খরচ বাবদ দিতেন। এখন পাঁচ দিনের বরাদ্দ কমে দাঁড়িয়েছে দশ হাজারে। তবু তার মধ্যেই পূজার্চনা সেরে মন্দির কমিটি এক দিন কীর্তন ও বাউল গানের আসর বসানোর চেষ্টা করতেন গত বছর পর্যন্ত।
এখানেই একসময় গান গেয়ে গিয়েছেন কামারকুণ্ডুর বিখ্যাত কীর্তনীয়া জুড়ি ‘সতীশ মান্না ও জবারানি’ কিংবা সিঙ্গুরের ‘নিতাইদাস বাউল’। এখন অবশ্য স্থানীয় শিল্পীরাই ভরসা। এমনকী আশপাশের জেলা থেকে নামী বাউল শিল্পীদের আনারও সামর্থ্য থাকে না সবসময়। বদল এসেছে ঝুলনের ভোগেও। আগে কীর্তন শেষে প্রতিদিনই রাজবাড়ির রসুই ঘরে লুচি, আলুর দম, কালিয়া এবং পোলাও খাওয়ানো হতো। এখন সেখানে ভক্তদের কপালে জোটে লুচি-সুজি। তবে নিয়ম মেনে ঝুলন চতুর্দশীতে ক্ষত্রিয় রাজাদের বংশানুক্রমিক ‘মহনদা পূজা’ বা ‘চন্ডীকাপূজা’ হয় এখনও। তবে রাজ পরিবারের কেউ আর আসেন না। কেবল রাজ কোষাগার থেকে আসে কিছু ‘তংকা’।
নতুনগঞ্জের রাধাবল্লভ মন্দিরের জৌলুসও আগের মতো নেই আর। এখন নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর সংসারে নিয়মনিষ্ঠা করে ঝুলন সাজানো হয়। প্রতিদিনই সন্ধ্যায় পালা কীর্তনও হয়। এমনকী ঝুলনে পাঁচ দিনের একদিন ‘রাইরাজাও’ সাজানো হয়। শ্যামসুন্দর মন্দিরেও ঝুলনের সময় প্রতিদিন নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও গান হয়। রাজগঞ্জের মোহন্তস্থলেও এখন নামে মাত্র ঝুলনযাত্রা হয়। অথচ এক কালে রাজাদের মোহন্ত বা পুরোহিতেরা বিশাল জাঁকজমক করে ঝুলন উৎসব করতেন সেখানে। এখন ঝুলন এলেই ছোটদের সেই সব ইতিহাস শোনাতে বলেন মোহান্তেরা।
অথচ কি দিন ছিল অতীতে!!!
সদর দরজাতে সাদা কাগজে আলতা দিয়ে লেখা থাকত ‘ঝুলন দেখে যান’, ‘পয়সা দিয়ে যান’– ইত্যাদি স্লোগান। দেখে তো ঠাকুরদাদের চোখ কপালে উঠত। এ কী ছেলেখেলা? ঠাকুমারা গলা উঁচিয়ে পাল্টা দিতেন, খেলাই তো! তোমাদের কেষ্ট যদি ... ময়দানে নামতেন মায়েরা। মানে মধ্যস্থতা করতেন। ঠাকুরদা-ঠাকুমা দ্বৈরথ থামত। মায়ের সংসারে টান পড়ত। কড়াইয়ের চার ধারে মাটি দিয়ে পুকুর বানানো হত। তাতে ভাসিয়ে দেওয়া হত মাজনে পাওয়া হাঁস। তুলসীতলার মাটিতে ঠাকুরদার পুরনো ধুতির টুকরো মাখিয়ে উল্টো আনাজের ঝুড়িতে ফেলে পাহাড় তৈরি করা হত। দোলের মেলা থেকে নানা পুতুল কেনা হত। সেই সৈন্য, দইওলা, ধানঝাড়ায় ব্যস্ত কৃষককৃষানি, পুকুরে জল আনতে যাওয়া বউ, ইত্যাদি দিয়ে সাদৃশ্যহীন এক মঞ্চ তৈরি করা হত। মাঝে দোলা খেতেন রাধাকৃষ্ণ। সন্ধ্যাবেলায় পাশের বাড়ির পুরুতদাদা আসতেন পুজো করতে। বাড়ির মা-কাকিমারা আনতেন লুচি-আলুভাজা আর পান্তুয়া। যাঁরা ঝুলন দেখে দক্ষিণা দিতেন তাঁদেরও ডাকা হত। প্রসাদ পেতেন সকলে। বসত বিনোদনের আসর। ঝুলনের গান, কবিতার সঙ্গে পরিবারের ছোটকা গান ধরতেন “দোলে দোদুল দোলে ঝুলনা”। সেই সময়ের হিট গান। বাড়ির ঠাকুমার কণ্ঠে শোনা যেত চণ্ডীদাস -
“সই কেবা শুনাইল শ্যাম নাম
কানের ভিতর দিয়ে মরমে পশিল গো
আকুল করিল মোর প্রাণ।”
কেউ হয়তো ধরতেন,
“গগনে কৃষ্ণ মেঘ দোলে
কিশোর কৃষ্ণ দোলে বৃন্দাবনে।
থির সৌদামিনী রাধিকা দোলে নবীন
ঘনশ্যাম সনে।।
দোলে রাধা শ্যাম ঝুলন-দোলায়
দোলে আজি শাওনে।। …”
এই রোম্যান্টিক গীতিকবিতা বাস্তবিকই অন্তরে ঢেউ তোলে। দুলে ওঠে হৃদিযমুনা, ব্যাকুল হয় প্রাণপাখি। স্বর্গের প্রেম নেমে আসে মর্ত্যে। দৈবপ্রেম মানবপ্রেমের মহিমা লাভ করে ধন্য হয়।





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Post Top Ad

Your Ad Spot