ভাগবত ও পুরাণ পাঠ

ভাগবত ও পুরাণ পাঠ :গৌর গদাধর সম্প্রদায় (সাটুই , মুর্শিদাবাদ)

Breaking

Post Top Ad

০৯ আগস্ট ২০২৪

লোটনষষ্ঠী ব্রত কী ও কেন পালন করবেন?

 শ্রাবণ মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠীতে হয় লোটনষষ্ঠী। সন্তানের মঙ্গলকামনায় পালন করে লোটন বা লুণ্ঠনষষ্ঠী ব্রত। এই ব্রত পালনে মায়েরা পুত্রশোক পায়না। সেইসাথে সংসার সুখকর হয়ে ওঠে। গর্ভবতী মহিলা হলেও এটি করা যায়। তবে কোনো বন্ধ্যা বা সন্তান উৎপাদনে অক্ষম মহিলা কিংবা বিধবা মহিলাদের এই লৌকিক উপচার পালন করার বিধান নেই। যেকোনো পুত্রবতী সধবা মহিলাদের একান্ত উৎসব এটি। নিজে অথবা পুরোহিত ডেকে পূজো করাতে হয়। কোনো কারণে দিনটি সোমবার, মঙ্গলবার, শুক্রবার কিংবা শনিবার পড়লে তবে সেদিন লোটনষষ্ঠীর পূজা করা যাবেনা। শুধুমাত্র নিয়মটুকু মেনে চলতে হবে।

'লোটন' ক্লী [√লুট্‌ + অন (ল্যুট্ )-ভা] বিচেষ্টন, গড়াগড়ি দেওয়া। 
'লুন্ঠন' অর্থে লুঠ করা বা হারক, নিরাসক বোঝায়। দস্যুবৃত্তি বা চৌর্য্যবৃত্তি বা অপহরণ বোঝায়। কথাসরিৎসাগরে আছে "দেশো মে লুন্ঠিতহনেন"! আবার 'লুন্ঠিত' অর্থে লুটিয়ে পড়া বোঝায়। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, "এই ছয়কোটি মুণ্ড ঐ পদপ্রান্তে লুন্ঠিত করিব"।

যিনি ব্রতীনী, তিনি সাতটি অথবা নয়টি নাড়ুতে গোবর মাখিয়ে মাটিতে ফেলে দেন। অর্থাৎ লুটিয়ে পড়ে নাড়ুগুলি। লুন্ঠিত হয় সেগুলি। এরপর চুলের সাহায্যে শালপাতার থালায় আবার এগুলিকে তুলে রাখেন। একেই বলা হয় 'লোটন তোলা'। ষষ্ঠীদেবীর পদতলে নাড়ু লুটিয়ে পূজো দেওয়া হয়। এই 'নাড়ু' আসলে সন্তান। দেবীর সামনে আত্মনিবেদন। সন্তানের যাবতীয় দায় দায়িত্ব সঁপে দেওয়া হোলো এভাবেই। তাই 'লোটনষষ্ঠী'। ব্রতীনীরা পূজোর কাজ শেষ হলে পরে দিনের বেলায় লুচি, মিস্টি, তরকারি খেয়ে উপোস ভঙ্গ করতে পারে। তবে রাতের বেলায় কেবলমাত্র ফল, ডাব, মিস্টি খেতে পারে। অন্য কিছু খাবার খাওয়া চলবে না।
                                                   
লোটনষষ্ঠী ব্রতের উপকরণ হল আতপ চাল, গুড়ের পিঠে, ছোট ছোট ক্ষীরের নাড়ু। আখের গুড়, ডাব, ঘি, ফল, মিস্টি, তরকারিও দেওয়া হয় কোথাও কোথাও। মেঝেতে আলপনা দিয়ে তার সামনে বটের ডাল রাখতে হবে। এবার তার সামনে ঘটস্থাপন করে তাতে দিতে হবে তেল, হলুদ বাটা এবং দই। এর সাথে সাতটি ( কোথাও কোথাও ৯ টি ) ক্ষীরের নাড়ু বা লোটন তৈরি করে ষষ্ঠীদেবীর কাছে নৈবেদ্য দিতে হয়। এই নাড়ুকেই 'লোটন' বলা হয়। পূজার শেষে দেবীকে প্রনাম করে লোটনষষ্ঠীর ব্রতকথা শোনার নিদান রয়েছে।

ব্রতের দ্রব্য ও বিধান— ব্রত পালনের উপকরণ হিসাবে লাগে ঘি, ঝিঙে, কড়াই, আখের গুড়, ফল, ডাব, মিষ্টি। পুরোহিতকে দিয়ে ব্রতের পূজা করাতে হয়। পূজার দিন অন্নভোজন করতে নেই। তবে দিনের বেলায় লুচি, তরকারি, মিষ্টি ও রাত্রিতে ফল, মিষ্টি, ডাব খাওয়া যেতে পারে। কেবলমাত্র সন্তানবতী মহিলারাই এই ব্রত পালন করতে পারেন।

ব্রতের ফল— এই ব্রত পালন করলে পুত্র-কন্যাদের অকালমৃত্যু হয় না


লোটনষষ্ঠীর ব্রতকথা :-
অনেক দিন আগে কোনও এক গ্রামে এক কায়স্থ পরিবারে কাদম্বিনী নামে এক গৃহিনী ছিলেন। পুত্র, কন্যা, নাতি, নাতনি নিয়ে বেশ সুখেই তাঁর দিন কাটছিল। প্রতি বছর শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে খুব ঘটা করে তাঁদের বাড়িতে লোটনষষ্ঠীর পূজা করা হত। অন্যান্য বছরের মতো সে বছরও কাদম্বিনীর বাড়িতে খুব ঘটা করে লোটনষষ্ঠী পূজার আয়োজন করেছিলেন। গ্রামের অনেক মেয়ে, বউরা এসেছিলেন পূজা দেখতে। এঁদের মধ্যে বিমলীর পিসি নামের একজন মধ্যবয়স্কা মহিলাও ছিলেন যাঁর অন্যের জিনিসের প্রতি লোভ ছিল। পূজার দিন পাড়ার অন্য সকলে পূজা শেষে প্রসাদ নিয়ে বাড়ি চলে গেলেও তিনি কাদম্বিনীর বাড়িতে বসে রইলেন। কাদম্বিনী পূজার সব জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখছেন, এমন সময় বাড়ির ভেতর থেকে কে যেন কাদম্বিনীকে ডাকল। কাদম্বিনী তখন বিমলীর পিসিকে বললেন, “তুমি তো এখানে আছ, দেখো ইঁদুর, বিড়ালে কোনও জিনিসে যেন মুখ না দেয়। আমি বাড়ির ভেতর থেকে ঘুরে আসছি।” বিমলীর পিসি বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ, তুমি ঘুরে এসো, আমি এখানে বসে থাকছি।” কাদম্বিনী চলে গেলে বিমলীর পিসি পূজার সব জিনিস দেখছিলেন। সেই সময় হঠাৎ তাঁর চোখ পড়ল ছোট্ট একটা কৌটোর দিকে। তিনি তখন চারপাশ ভাল করে দেখে নিয়ে কৌটোর মুখটা খুলে ফেললেন। দেখলেন, তার মধ্যে ছয়টি সোনার তৈরি লোটন রয়েছে। তিনি আর লোভ সম্বরণ করতে না পেরে কৌটো থেকে তিনটি লোটন তুলে নিলেন। এরপর তিনি যখন কৌটোর মুখ বন্ধ করছেন, সেই সময় কদম্বিনী ফিরে এলেন। কাদম্বিনীর সন্দেহ হল, কিন্তু তিনি কিছু বললেন না। বিমলীর পিসিও প্রসাদ নিয়ে বাড়ি চলে গেলেন।

কাদম্বিনী সব জিনিস ভাল করে দেখে গোছাবার সময় দেখলেন, কৌটো থেকে তিনটি লোটন উধাও। তিনি তখনই বিমলীর পিসির কাছে গিয়ে বললেন, “আমার কৌটাতে তিনটি লোটন নেই, সেগুলি নিশ্চয়ই তুমি নিয়েছ, শীঘ্র ফেরত দাও।” কিন্তু বিমলীর পিসি জানালেন, তিনি লোটন চুরি করেননি। কাদম্বিনী কাঁদতে কাঁদতে মা ষষ্ঠীকে বললেন, “হে মা ষষ্ঠী! যে আমার সোনার লোটন চুরি করেছে, তাঁকে শাস্তি দাও।”

এই ঘটনার কিছু দিন পরেই বিমলীর পিসির তিন পুত্র একই সঙ্গে কঠিন অসুখে পড়ল। কারও আর বাঁচার আশা রইল না। বিমলীর পিসি কান্নাকাটি করতে লাগলেন। এর মধ্যেই একদিন বিমলীর পিসি স্বপ্ন দেখলেন। স্বপ্নে মা ষষ্ঠী তাঁকে দেখা দিয়ে বললেন, “তুই কাদম্বিনীর কৌটো থেকে সোনার লোটন চুরি করেছিস।তাই তোর আজ এই অবস্থা। যদি ভাল চাস, তাড়াতাড়ি কাদম্বিনীর লোটনগুলি ফেরত দিয়ে আয়।তা না হলে তোর ভাল হবে না।”

এই স্বপ্ন দেখার পর বিমলীর পিসি খুব ভয় পেয়ে গেলেন। রাত শেষ হয়ে সকাল হতে না হতেই তিনি কাদম্বিনীর বাড়িতে গেলেন। কাদম্বিনীর কাছে নিজের দোষ স্বীকার করে নাকে খৎ দিয়ে লোটন তিনটি ফেরত দিয়ে দিলেন। কাদম্বিনী সব শুনে বললেন, “তুমি খুবই অন্যায় করেছিলে। মা ষষ্ঠীকে তুমি চেনো না। আর কখনও এমন কাজ করো না। এখন থেকে নিয়মিত মা ষষ্ঠীর ব্রত পালন করো। তা হলে তোমার ছেলেমেয়েরা ভাল থাকবে এবং সংসারে কোনও অভাব থাকবে না। এখন বাড়ি যাও তোমার সন্তানরা যাতে সুস্থ হয়ে ওঠে তার জন্য মায়ের কাছে প্রার্থনা করো।”

বিমলীর পিসি তখন কাদম্বিনীর কাছে ষষ্ঠী পূজার নিয়ম জানতে চান। কাদম্বিনী বললেন, “প্রতি বছর শ্রাবণ মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠীর দিন ষোলো মুথুনিতে বাঁশপাতা বেঁধে সেটি জলের মধ্যে পুঁতে দিতে হবে। আর যে ক’টি সন্তান থাকবে সেই কটি জালি ঝিঙে এবং কিছুটা কড়াই ভেজানো দিয়ে ভক্তি ও শ্রদ্ধার সঙ্গে মা ষষ্ঠীর পূজা করতে হবে। পূজার শেষে ব্রত কথা শুনে জল খেতে হবে। বিমলীর পিসি সব শুনে তখনই বাড়ি ফিরে গেলেন। বাড়ি ফিরে ঠাকুর ঘরে গিয়ে মাথা খুঁড়তে খুঁড়তে মা ষষ্ঠীকে বলতে লাগলেন, “হে মা ষষ্ঠী! আমার ছেলেদের বাঁচিয়ে দাও মা। এখন থেকে সারা জীবন ধরে আমি তোমার ব্রত পালন করব। আমার অপরাধ ক্ষমা করো মা।” মায়ের দয়ায় বিমলী পিসির ছেলেরা অল্প কয়েক দিনের মধ্যে সেরে উঠল। তখন থেকে মা ষষ্ঠীর মাহাত্ম্যের কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। আর তখন থেকে সকলে নিজের নিজের পুত্র-কন্যার কল্যাণের কথা ভেবে লোটনষষ্ঠী ব্রত পালন করতে শুরু করল।

মা ষষ্ঠীর লোটন লুঠ বা চুরি হয়েছিল বলে এই ব্রতের আর এক নাম লুন্ঠন ষষ্ঠী।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Post Top Ad

Your Ad Spot