সর্বপ্রথম বেদ থেকে উদ্ভুত বামন হলেন হিন্দু মহাকাব্য এবং পুরাণে সবচেয়ে বেশি আলেচিত চরিত্র যেখানে বামন, দৈত্যরাজ বলির কাছ থেকে ত্রিপাদ স্থানের বিনিময়ে তিন লোক বা ত্রিলোক পুনরুদ্ধার করেন। এতে ত্রিজগতে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়, তিনি আদিত্যদের মধ্যে সর্বকনিষ্ট এবং ঋষি কশ্যপ ও মাতা অদিতির পুত্র। বামন পুরাণ অষ্টাদশ হিন্দুপুরাণের অন্যতম এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ হিন্দু ধর্মগ্রন্থ। এই পুরাণটি বিষ্ণুর বামন অবতারের নামে নিবেদিত এবং বামন অবতারের কাহিনি উক্ত হয়েছে।
পুরাণ মতে মহামতী রাজা বালী শ্রীহরি ভক্ত প্রহ্লাদের পৌত্র্র এবং বিরোচনের পুত্র ছিলেন। দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য্যের আশীর্বাদে পরম শক্তিশালী দৈত্যরাজে পরিণত হন। মহা পরাক্রমশালী রাজা বালী মর্ত্যলোক এবং পাতাল অধিকারের পর স্বর্গের রাজধানী অমরাবতীর সিংহাসনে নিজেকে আসীন দেখার জন্য গুরু শুক্রাচার্য্যের পরামর্শে বিশ্বজিৎ যজ্ঞ শুরু করেন। সেই যজ্ঞের যজ্ঞকুন্ড থেকে একে একে আবির্ভূত হয় দেবরাজ ইন্দ্রের রথের সাদৃশ্য বহু মূল্যবান রত্নখোচিত সুসজ্জিত রথ, অসংখ্য তীরযুক্ত অক্ষয় বাণ, সোনার ধনুক এবং দিব্যবর্ম।তথায় উপস্থিত প্রজাপতি ব্রহ্মা দান করিলেন দিব্যমাল্য আর শুক্রাচার্য্য দিব্য শঙ্খ। যজ্ঞকুন্ড হইতে আবির্ভূত সমস্ত দিব্যবস্তু ধারণ করিয়া সম্রাট বালী নতজানু হয়ে পিতামহ প্রহ্লাদ, গুরু শুক্রাচার্য্য এবং যজ্ঞ ভূমিতে উপস্থিত সমস্ত ঋষিদের আশীর্বাদ প্রার্থনা করিলেন। তাঁদের আশীর্বাদে বলান্বিত, দিব্যভূষণ এবং দিব্য আয়ূধে সজ্জিত চক্রবর্তী রাজা বালী, স্বর্গরাজ্য আক্রমণের জন্য সিংহনাদে গর্জন করিতে করিতে স্বর্গের রাজধানী অমরাবতীর দিকে ধাবিত হন।
অমরাবতীতে প্রবেশ করিয়া রাজা বালী গুরু শুক্রাচার্য্য প্রদত্ত দিব্য শঙ্খ বাজাইলেন। সেই শঙ্খ ধ্বনি তে ভীত ও সন্ত্রস্ত হইয়া দেবতাগন স্বর্গের রাজা ইন্দ্রের সাহায্য প্রার্থী হইলেন। । দেবরাজ ইন্দ্র স্বয়ং বালীর তেজ, সাহসিকতা, উদ্যম এবং সুদক্ষ সেনাবাহিনীর সম্মুখে পরাজয় স্বীকার করিলেন। দেবতাদের স্বর্গ হইতে বিতাড়িত করিয়া বালী স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতালের একছত্র অধিপতি রূপে ত্রিলোকের শাসন করিতে লাগিলেন। দেবতাদের দুর্দশা দর্শন করিয়া মাতা অদিতি (অদিতির পুত্রদেরকে বলা হয় আদিত্য বা দেবতা) ও পিতা কাশ্যপ ভগবান নারায়ণের শরণাপন্ন হন এবং তাঁকে সন্তুষ্ট করার জন্য পয়োব্রত করেন। পয়োব্রত ফাল্গুন মাসের শুক্ল পক্ষের প্রতিপদ তিথিতে শুরু করে দাদ্বশী তিথি পর্য্যন্ত করা হয়। ” ॐ নমঃ ভগবতে বাসুদেবায়” এই দ্বাদশ অক্ষর মন্ত্র উচ্চারণের সাথে গন্ধ (চন্দন), পুষ্প, ধূপ, দীপ ও নৈবদ্য শ্রীনারায়ণকে নিবেদন করা হয়। মাতা অদিতির পূজায় সন্তুষ্ট হয়ে ভগবান নারায়ণ তাঁকে বর দেন যে তিনি তাঁর গৃহে পুত্র রূপে জন্ম গ্রহণ করিবেন এবং দেবতাদের স্বর্গরাজ্যে পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করিবেন।
শ্রীবিষ্ণুর বামন অবতার -
বামন
দশাবতার গোষ্ঠীর সদস্য
চিত্র: বামন, বিষ্ণুর এক অবতার যিনি বলিকে নিজের পায়ের চাপে পাতালে পাঠিয়ে দেন। রাজা রবি বর্মা কর্তৃক অঙ্কিত চিত্র।
ঋষি কাশ্যপ এবং দেবমাতা অদিতির কঠিন ব্রতের ফলস্বরূপ যথাসময়ে শ্রীহরি বামন রূপে ধরাধমে অবতীর্ণ হন। তিনি জন্ম গ্রহণ করেছিলেন ভাদ্র মাসের শুক্ল পক্ষের দ্বাদশী (বিজয়া দ্বাদশী) তিথিতে, শ্রবণা নক্ষত্রে অভিজিৎ মুহূর্তে। শিশুর জন্মের সাথে সাথে তাঁর দেহের দিব্য দ্যুতিতে কাশ্যপ মুনির আশ্রমের চর্তুদিক আলোয় উদ্ভাসিত হয়, তমসা দূরীভূত হয়। স্বর্গ ও মর্ত্যবাসীদের মন এক অদ্ভুত আনন্দে উৎফুল্লিত হয়। স্বর্গে গন্ধর্বগণ শঙ্খ, মৃদঙ্গ, দুন্দুভি, ঢাক, মাদল ইত্যাদি বাদ্য বাজাইতে থাকেন আর মেনকা, রম্ভা উর্বশী আদি অপ্সরাগণ বাদ্যের তালে তালে নৃত্য করিতে থাকেন। সিদ্ধগণ, বিদ্যাধরগণ, কিন্নরগণ, নাগদেবতা এবং পিতৃদেবগণ স্তব স্তুতি করিতে থাকেন। দেবগণ স্বর্গ হইতে কাশ্যপ মুনির আশ্রমে পুষ্পবৃষ্টি করিলেন। নবজাতকের দর্শন হেতু সপ্ত ঋষি (ভরদ্বাজ, গৌতম, কাশ্যপ, বিশ্বামিত্র, জমদগ্নি, বৈশিষ্ট্য এবং অত্রী), অষ্ট দিকপাল, বায়ুগণ, বিশ্বদেবগণ, সাধ্যদেবগণ, নাগদেবগণ কাশ্যপ মুনির আশ্রমে পদার্পণ করিলেন। শত সহস্র সূর্য্যের সমান জ্যোতির্ময় বালককে স্বয়ং প্রজাপতি ব্রহ্মা নতজানু হয়ে প্রণাম করিলেন। শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্মধারী শ্রীনারায়ণের পঞ্চম অবতার বামন অবতারের সম্মুখে সমস্ত দেবগণ, মহা শক্তিশালী দৈত্যরাজ বালীকে পরাজিত করিয়া স্বর্গরাজ্য পুর্নরুদ্ধারের জন্য করজোড়ে বারংবার প্রার্থনা করিতে লাগিলেন। ধীরে ধীরে সকলের আহ্লাদে এবং যত্নে বর্দ্ধিত হইতে লাগিলেন বালক। উপনয়নের সময় আগত হইলে সূর্য্যদেব স্বয়ং বালককে দিলেন গায়িত্রী মন্ত্র। দেবগুরু বৃহস্পতি দিলেন উপবীত, পিতা কাশ্যপ দিলেন ব্রহ্মোপদেশ, ভূদেবী দিলেন পবিত্র মৃগচর্ম, চন্দ্রদেব দিলেন ডণ্ড, মাতা অদিতি দিলেন কৌপিন্য, দেবী ভুবনেশ্বরী দিলেন স্বর্গীয় ছত্র, ব্রহ্মা দিলেন কমুন্ডল, সপ্তর্ষি দিলেন দুর্বা, দেবী স্বরসতী দিলেন জপমালা এবং কুবের দিলেন ভিক্ষাপাত্র। সমস্ত দিব্য ভূষণে আভূষিত হয়ে সেই জ্যোতির্ময় বালক অগ্রসর হইলেন মহাবলশালী রাজা বালীর রাজসভার উদ্দেশ্যে, দেবতাদিগকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষার্থে, স্বর্গরাজ্য পুর্নরুদ্ধারে।
অশ্বমেধ যজ্ঞশালায় বামন অবতারের প্রবেশ
দৈত্যরাজাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ও মহানতম রাজা বালী গুরু শুক্রাচার্য্যের পরামর্শে অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠানে নিয়োজিত ছিলেন। দাতা হিসাবে রাজা বালীর সুখ্যাতি ছিল। বামন অবতার তাহা অবগত ছিলেন। দেবগুরু বৃহস্পতিকে নিয়ে তিনি উপস্থিত হইলেন রাজা বালীর অশ্বমেধ যজ্ঞশালায়। সাধারণ ব্রহ্মচারীর মতো পরিধান হইলেও বালকের বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা এবং দিব্য কান্তি যজ্ঞস্থিত সকলকে বিস্মিত করিল। রাজা বালী স্বয়ং বামন অবতারের পা ধৌত করিলেন এবং বলিলেন বালকের কোনো প্রার্থনা থাকিলে যেমন সাম্রাজ্য, ঐশ্বর্য, প্রতিপত্তি তাঁহার নিকট প্রকাশ করিতে তিনি তাহা পূর্ণ করিবেন। প্রত্যুত্তরে বামন অবতার রাজা বালী ও তাঁর বংশের পূর্বসূরিদের প্রশংসা করিলেন।প্রহ্লাদ, হিরণ্যকশিপু, হিরণ্যাক্ষ, বিরোচনের মতো মহান দৈত্যকুলে জন্ম রাজা বালীর, যাহারা প্রাণ রক্ষা অপেক্ষা ধর্ম রক্ষাকে শ্রেয় মনে করিতেন। বামন অবতার বলিলেন তাঁর সাম্রাজ্য, ঐশ্বর্য, প্রতিপত্তি প্রাপ্তির ইচ্ছা নাই। তাঁর প্রয়োজন কেবলমাত্র তিন পদক্ষেপের সমপরিমাণ জমি, দেবগুরু বৃহস্পতির জন্য যজ্ঞশালা নির্মাণ হেতু। রাজা বালী বালকের সামান্য চাহিদায় তাঁর নির্বুদ্ধিতা ও অনভিজ্ঞতা প্রকাশে অট্টহাস্য করিতে লাগিলেন। বামন অবতার বলিলেন যে জীবের ইচ্ছার উপর সর্বদা সংযত থাকা উচিত। প্রয়োজন অনুযায়ী চাহিদা প্রকৃত চাহিদা। প্রয়োজনের অতিরিক্ত প্রাপ্য জীবনে অধর্ম, অসত্য, অতৃপ্তি এবং অন্যায়কে আনয়ন করে। সুতরাং তাঁর বাসনা তিন পদক্ষেপের সমপরিমাণ মৃত্তিকা ব্যতীত অন্য কিছু নয়। দাতা বালী বামন অবতারের ইচ্ছায় সম্মত হইলেন। তথায় উপস্থিত গুরু শুক্রাচার্য্য বালকের প্রকৃত পরিচয় এবং অভিপ্রায় বুঝিতে পারিয়া রাজা বালীকে অঙ্গীকার প্রত্যাখ্যানের জন্য বারংবার অনুরোধ করিতে লাগিলেন। কিন্তু দানবীর বালীর নিকট প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ অপেক্ষা মৃত্যু শ্রেয়।
গুরুর সাবধানবানী অগ্রাহ্য করিয়া প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী রাজা বালী জমি প্রদানের জন্য অগ্রসর হইলেন। সেই মূহুর্তে বামন অবতার বিশাল আকার ধারণ করিলেন। প্রথম পদক্ষেপ তিনি মর্ত্যলোকে রাখিলেন, সমস্ত পৃথিবী এবং আকাশ তাহা পরিব্যাপ্ত করিল। দ্বিতীয় পদক্ষেপ সমগ্র স্বর্গলোককে আবরণ করিল। তৃতীয় পদক্ষেপ রাখিবার কোনো স্থান নাই। পরিণাম অবগত হইয়াও রাজা বালী সশ্রদ্ধায় নিজ মস্তক অগ্রসর করিয়া দিলেন বামন অবতার রূপী ভগবান নারায়ণকে, তাঁর তৃতীয় পদক্ষেপ রাখিবার জন্য। ভগবান নারায়ণ বালীকে পাতাললোকে প্রেরণ করিলেন। এইভাবে স্বর্গরাজ্য পুনরায় দেবতাদের অধীন হইল। শ্রীবিষ্ণু ও রাজা বালীকে আশীর্বাদ করিলেন যে তিনি চিরঞ্জিবী হইবেন। দৈত্যকুলের শ্রেষ্ঠ সম্রাট এবং শ্রীহরির প্রিয়ভক্ত হিসাবে মর্ত্যলোকে পূজিত হইবেন। তাই কার্তিক মাসের শুক্ল পক্ষের প্রতিপদ তিথিতে (বালী প্রতিপদ) রাজা বালীর পূজা হয়ে থাকে।
সকল মানুষকে মোহ থেকে বাস্তবতা, জড় থেকে চিন্ময়তা, অনিত্য থেকে নিত্যতার পার্থক্য নির্ণয়ে সহায়তা করা , সকল জীবকে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা স্মরণ করানো ও তাঁর সেবা করতে সহায়তা করা।
আবেদন
এই ব্লগটি তৈরির কাজ বিশেষ অনিবার্য কারণে সাময়িক বন্ধ রাখা হলো। আগামী ৩১.০৮.২০২৪ পর্যন্ত। তাই জন্মষ্টমী উৎসবের যাবতীয় তথ্য কিছুদিনের মধ্যেই প্রকাশ করা হবে। Edtior Desk Ajay Kr Dey
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন