❝স্ত্রীণামনুপনীতানাং শূদ্রাণাঞ্চ মহীশ্বর।
স্পর্শনে নাধিকারোহস্তি বিষ্ণোর্ব্বা শঙ্করস্য চ।।
শূদ্রো বানুপনীতো বা স্ত্রী বাপি পতিতোহপি বা।
কেশবং বা শিবং বাপি স্পৃষ্ট্বা নরকমাপ্নুয়াৎ।।❞ —(বৃহন্নারদীয় পুরাণ)—
বাংলা অনুবাদঃ— স্ত্রী, শূদ্র এবং অনুপবীতের শালগ্রামশিলা এবং ব্রাহ্মণ প্রতিষ্ঠিত শিবলিঙ্গ স্পর্শ করিবার অধিকার নেই, স্পর্শ করিলে পতিতপূর্ব্বক নরকগামী হইতে হবে।
❝স্ত্রীশূদ্রপতিতানাঞ্চ ষন্ডানাঞ্চ বিকর্ম্মণাম্। নৈবাধিকারে। বিজ্ঞেয়ঃ শালগ্রাম শিলার্চ্চনে।❞
বাংলা অনুবাদঃ— স্ত্রী, শূদ্র, পতিত, পাষন্ড এবং বিকর্ম্মীদের শালগ্রামশিলার্চ্চনে কোনপ্রকার অধিকার নেই।
❝স্ত্রীশূদ্রকরসংস্পর্শে বজ্রস্পর্শাধিকো মতঃ।।
মোহাদ্ যঃ সংস্পৃশেচ্ছূদ্রো যোষিদবাপি কদাচন
শয়তে নরকে ঘোরে যাবদাভূতসংপ্লবম্।।❞ —(বরাহপুরাণ)—
বাংলা অনুবাদঃ— বরাহদেব নিজ মুখে বলছেন— স্ত্রীলোক এবং শূদ্র জাতির করস্পর্শ বজ্রের স্পর্শাপেক্ষার অধিক হয়। মোহের বশবর্তী হয়ে যদি কোন শূদ্র বা নারী শালগ্রামশিলা স্পর্শ করে থাকেন তাহলে প্রলয়কাল পর্যন্ত তাহাকে নরকযাপন করতে হবে।
❝ন জাতু বৈ স্ত্রিয়া কার্য্যং শালগ্রামস্য পূজনম্।
ভর্ত্তৃহীনাথ সুভগা স্বর্গলোকহিতৈষণী।।
মোহাৎ স্পৃষ্ট্বাত মহিলা জন্মশীলগুণান্বিতা।
হিত্বা পুণ্যসমূহন্তু সত্বরং নরকং ব্রজেৎ।।
স্ত্রীপাণিমুক্তপুষ্পাণি শালগ্রামশিলোপরি।
সর্ব্বাভ্যধিকপাপানি বদন্তি ব্রাহ্মণোত্তমাঃ।।
চন্দনং বিষপঙ্কাভং কুঙ্কুমং বজ্রসন্নিভম্।
নৈবেদ্যং কালকূটাভং ভবেদ্ভগবতঃ কৃতম্।।
তস্মাৎসর্ব্বাত্মনা ত্যাজ্যঃ স্ত্রিয়া স্পর্শঃ শিলোপরি।
কুর্ব্বতী যাতি নরকং যাবদিন্দ্রাশ্চতুর্দ্দশ।।❞ —(পদ্মপুরাণ, পাতালখন্ড)—
বাংলা অনুবাদঃ— পরলোকশুভাভিলাষিণী স্বামীসৌভাগ্য-শালিনী বা ভর্ত্তৃহীনা নারী কখনোই শালগ্রামশিলার পূজা করিবেন না। সৎকূলজাতা সর্ব্বসদ্ গুণাসম্পন্না নারী মোহবশতঃ শালগ্রাম স্পর্শ করিলে পূর্ব্বকৃত পূণ্যরাশি হারাইয়া সত্বর নরকগামিনী হইবেন। শালগ্রাম শিলার উপর নারীহস্ত মুক্ত পুষ্পই সর্ব্বপেক্ষা অধিকতর পাপজনক। স্ত্রী হস্তক্ষিপ্ত চন্দন বিষপঙ্কবৎ, কুমকুম বজ্র সদৃশ এবং নৈবেদ্য কালকূটবৎ কথিত হইয়া থাকে। তজ্জন্য স্ত্রীগণের শালগ্রাম স্পর্শ সর্ব্বদা অবিহিত। নিষেধবিধি অতিক্রম করিয়া কোন নারী শালগ্রাম স্পর্শাদি করিলে নিশ্চয়ই চতুর্দ্দশ- ইন্দ্রাধিকার ব্যাপককালে নরক বাস করিবে।
❝ব্রাহ্মণস্যৈব পূজ্যোহহং শুচেরপ্যশুচেরপি।
স্ত্রীশূদ্রকরসংস্পর্শো বজ্রপাতোধিকো মম।।❞ —(লিঙ্গ পুরাণ)—
বাংলা অনুবাদঃ— স্বয়ং ভগবান বলিতেছেন- কেবলমাত্র ব্রাহ্মণই শুচি কিনবা অশুচি অবস্থায় আমার পূজা করিতে পারে। স্ত্রী এবং শূদ্রের স্পর্শ আমার নিকট বজ্রপাতের চেয়েও অধিক পীড়াদায়ক।
❝বিপ্র-ক্ষত্রিয়-বৈশ্যানাং শালগ্রামশিলার্চ্চনে।
অধিকারো ন শূদ্রানাং হরেরেবার্চ্চনে তথা।।❞ —(ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, শ্রীকৃষ্ণ জন্মখন্ড)—
বাংলা অনুবাদঃ— বিপ্র ক্ষত্রিয় বৈশ্যর শালগ্রামশিলার্চ্চনে অধিকার আছে কিন্তু শূদ্রের তাহাতে নেই।
❝বৃহৎ তন্ত্রসার❞ নামক কালজয়ী পুস্তকে উল্লেখ —
❝প্রণবোচ্চারণাৎ হোমাৎ শালগ্রামশিলার্চ্চনাৎ। ব্রাহ্মণীগমনাচ্চৈব শূদ্রশ্চান্ডালতাং ব্রজেৎ।।❞
বাংলা অনুবাদঃ— প্রণব উচ্চারণ, যজ্ঞ এবং শালগ্রামশিলা স্পর্শ এবং ব্রাহ্মণী বিবাহ করলে শূদ্র চন্ডালে পরিণত হয়।
বৃহৎ তন্ত্রসারে সুস্পষ্টরূপে —
❝স্ত্রীশূদ্রকরসংস্পর্শো বজ্রপাতো মমোপরি ইতি ভগদ্বচনাৎ।❞
সুতরাং স্ত্রী-শূদ্রের হাতের ছোঁয়া স্বয়ং ভগবানের মস্তকে বাজ পরার সমান। ইহা কোন মনুষ্যকল্পিত বচন নয়; ইহা স্বয়ং বিরাট পুরুষ নারায়ণের উক্তি। অতএব কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ যখন এই ভগবদুক্তি বিষয়ে নিশ্চিত তখন অযথা সন্দেহ প্রকাশ করিবার কোন অবকাশ নেই।
❝যদি ভক্তির্ভবেত্তস্য স্ত্রীণাং বাপি বসুন্ধরে।
দূরাদেবাস্পৃশন্ পুজাং কারয়েৎ সুসমাহিতঃ।।
চরণামৃতপানেন সর্ব্বপাপক্ষয় ভবেৎ।❞ —(বরাহপুরাণ)—
অস্যার্থ এই যে, যদি শূদ্র কিনবা নারী দূর হইতে স্পর্শ না করিয়া ভক্তি যোগে অনন্য মনে পূজা করে তবে সে বিষ্ণুর চরণামৃত পানে সকল পাপ হইতে মুক্ত হয়।
পূর্ব্বোক্ত শ্লোকগুলি পর্যালোচনা করলে সহজেই প্রতীতি হয় স্ত্রী (উচ্চকোটি স্তরের হলেও) এবং শূদ্রের শালগ্রাম স্পর্শ তীব্রভাবে নিষিদ্ধ। স্বয়ং ভগবানের বচন দ্বারা তাহাই অনুমিত হয়। তাহারা স্পর্শ না করে পূজা করানোর অধিকারী। যথা পদ্মপুরাণে—
❝দীক্ষাযুক্তৈস্তথা শূদ্রৈর্মদ্যপানবিবর্জ্জিতৈঃ। কর্ত্তব্যং ব্রাহ্মণদ্বারা শালগ্রামশিলার্চ্চনম্।।❞
অতএব নিঃসংকোচে প্রতিষ্ঠিত হয় নারীদের এবং শূদ্রগণের শিলাচক্রের স্পর্শনীয়পূজাধিকার নেই।
শালগ্রাম শিলার উৎপত্তি কোথা থেকে?
প্রথমেই এটা জেনে রাখা প্রয়োজন যে, সারা পৃথিবীতে একমাত্র নেপালের পশ্চিমে, হিমালয় পর্বতের ১২৫০০ ফুট ওপরে, যেখানে যাওয়ার একমাত্র উপায় হাঁটা পথ, সেখানে গণ্ডকী বা কালী-গণ্ডকী নামক নদীতেই একমাত্র প্রকৃত শালগ্রাম শিলা পাওয়া যায়, সেই জায়গাই হল নারায়ণের মুক্তি-তীর্থ-ক্ষেত্র বা মুক্তিনাথ। এছাড়া আর কোনো জায়গায় শালগ্রাম পাওয়া যায় না। কোথাও না॥
শালগ্রাম শিলা কি?
আজকের হিমালয় একসময়ে ছিল সমুদ্রগর্ভে। আজ থেকে প্রায় তিন কোটি বছর আগে সেনোজয়িক কালে, ইয়োসিন যুগের শেষ ভাগে, টেথিস সমুদ্র থেকে হিমালয় আস্তে আস্তে মাথা তুলতে শুরু করে আর তা শেষ হয় প্লাইস্টোসিন উপ-যুগে যা প্রায় এক কোটি বছর আগের কথা। ফলে, এক মহা অতীত কালের সামুদ্রিক পলি এবং প্রস্তরের স্তর রূপান্তরিত হয়েছে আজকের হিমালয়ের শিলাস্তরে।
হিমালয়ের এই শিলাস্তর কে বলা হয় “স্পিতি” শেল। খুব সুক্ষ্ম দানা পলি অবক্ষেপ (সেডিমেন্টেশন) থেকে তৈরী হয়েছে বলে, বিজারক পরিবেশে সৃষ্ট এই শেল এত তৈলাক্ত ও কুঁচকুঁচে কালো। আজ থেকে আঠারো কোটি বছর আগে, জুরাসিক যুগে — যে সময়ে ডাঙ্গায় ডাইনোসরেরা রাজত্ব করছে – সেই সময়ে এই পলি অবক্ষেপ ঘটেছিলো। তার বহু বহু কোটি বছর পরে সমুদ্রগর্ভ থেকে জন্ম নিল হিমালয়। এর ফলে, আজকের হিমালয়ের চিরতুষারাবৃত স্পিতি শেল শিলাস্তরে পাওয়া যায় জুরাসিক যুগের সামুদ্রিক জীবের প্রস্তরীভূত জীবাশ্ম। কালী-গণ্ডকীর উৎপত্তিও সেই চিরতুষারাবৃত অঞ্চলেই।
তবে জলের তীব্র স্রোতে ওই শিলাস্তরের ক্রমাগত ক্ষয় হচ্ছে। ধুয়ে মুছে ভেঙে নিয়ে আসছে বলে কালীগণ্ডকীর জলের রঙ এত স্বচ্ছ অথচ কালো। তাই তার নাম কালী-গন্ডকি। আর ওই শিলাস্তরের খাঁজে লুকিয়ে থাকা জুরাসিক যুগের অজস্র প্রস্তরীভূত সামুদ্রিক জীবাশ্ম জলের স্রোতে চলে আসছে। এই অজস্র শিলাভূত জীবাশ্মর মধ্যে একমাত্র "অ্যামনোয়ডিয়া গোষ্ঠীর শিলাভূত জীবাশ্মই" হল হিন্দুদের পরম পবিত্র শালগ্রাম শিলা বা নারায়ণ শিলা।
প্যালিয়োজয়িক যুগের শুরুতে, মানে আজ থেকে প্রায় ৬০/৬৫ কোটি বছর আগে মলাস্কা অর্থাৎ শামুক জাতীয় প্রাণী পর্বের আদি প্রাণী সেফলোপডের আবির্ভাব। তারপর বিবর্তনের ধারা বেয়ে ২৩/২৫ কোটি বছর আগে এল এই অ্যামোনয়ডিয়া এবং তারই এক জ্ঞাতি ভাই অ্যামোনাইট গোষ্ঠীর এবং জুরাসিক থেকে ক্রিটেশিয়াস, মানে ৮ থেকে ১৫ কোটি বছর আগে এই অ্যামোনাইটের এত আধিক্য ছিল যে এই সময়কালকে বলা হয় অ্যামোনাইট যুগ। এই অ্যামোনাইট বিবর্তিত হয় বহু গণে। যার মধ্যে একটি হোল ‘পেরিসস্ফিংটিস ‘ এই পেরিস্ফিংটিস থেকে প্যারাবলিসোরাঁস, ভিরগাটোস্ফিংটিস আর অলাকোস্ফিংটিস,এই তিন উপগণ আর তাদের থেকে যেসব প্রজাতি জন্ম নিল, প্রধানতঃ তাদের জীবাশ্ম সম্বলিত শিলাকেই হিন্দুশাস্ত্রে পরম পবিত্র — সাক্ষাৎ নারায়ণ জ্ঞানে, শালগ্রাম শিলা রূপে পুজো করা হয়ে থাকে।
চিরতুষারাবৃত হিমালয় থেকে বয়ে আসা গণ্ডকী নদী ছাড়াও, নর্মদা তীরে এবং কচ্ছের কোন কোন জায়গায় শালগ্রাম শিলা পাওয়া যায়। কিন্তু, সেগুলি সবই ত্যাজ্য শিলা। কোনোটাই সনাতন ধর্ম মতে পূজ্য নয়।।
পুরাণে আছে, হিমালয়ের দক্ষিণে গণ্ডকীর উত্তরে দশ যোজন বিস্তৃত অঞ্চল হল – হরিক্ষেত্র। ভগবান বিষ্ণু এখানে অবস্থান করছেন শালগ্রাম শিলা রূপে। মহাভারতেও পাই এই মহাতীর্থের উল্লেখ। ভীষ্মের তীর্থ পরিক্রমার সময়ে মহর্ষি পুলস্ত্য মুনি তাঁকে গণ্ডকী ও শালগ্রাম তীর্থ দর্শনের উপদেশ দিয়েছিলেন। অথচ আশ্চর্যের কথা — অধিকাংশ হিন্দুদের কাছে এই হরিক্ষেত্র আজও যথেষ্টই অপরিচিত।
কি কান্ড? আসলে আমরা একটা শামুকের জীবাশ্ম কে নারায়ণ জ্ঞানে পূজো করি? এও কি সম্ভব? কোথায় পরম পবিত্র নিত্য প্রতিষ্ঠিত নারায়ণ আর কোথায় জীবাশ্ম (ফসিল)? এসবই মনে হয় যেন অবিশ্বাসীর বানানো গল্প।
কিন্তু তা ত নয়। আমাদের প্রাচীন শাস্ত্রকার ঋষিরা এত অর্বাচীন ছিলেন না। তাদের শিলাচর্চা বা জীবাশ্ম সম্পর্কে জ্ঞান কিছু কম ছিলনা। সেকালের শাস্ত্রীয় শিলা বিজ্ঞানীরাও জানতেন শালগ্রাম শিলা — ‘বজ্রকীট’ (এক ধরণের শামুক জাতীয় প্রাণী। শামুক (mollusca) জাতীয় প্রাণীর একটি বৈশিষ্ট হলো বহিঃ কঙ্কাল (exoskeleton)। ... আমাদের অস্থি কঙ্কাল ইত্যাদি ভিতরে থাকে (endoskeleton) আর মাংস বাইরে আর এদের ঠিক উল্টো। এদের বাইরেটা হাড়ের আবরণের জন্যে শক্ত। তাই ঋষিরা এদের বজ্রকীট বলেছেন। বজ্র কঠিন দেহ বিশিষ্ট। পুরো বিজ্ঞানটাই জানতেন ঋষিরা।) — এর দেহাবশেষের প্রস্তরীভূত রূপ — ফসিলই হলো আসলে শালগ্রাম শিলা। পুরাণে নারায়ণের উক্তি —
"অহঞ্চ শৈলরূপী চ গণ্ডকীতীর সন্নিধৌ। অধিষ্ঠানং করিষ্যামি ভারতে তব শাপতঃ।। বজ্রকীটাশ্চ কৃময়ো বজ্রদংষ্ট্রাশ্চ তত্র বৈ। মচ্ছিলাকুহরে চক্রং করিষ্যন্তি মদীয়কম।। ...গণ্ডক্যাশ্চোত্তরে তীরে গিরিরাজস্য দক্ষিণে......( ব্রহ্মপুরাণ, প্রকৃতি খণ্ড )।
শালগ্রাম শিলার গঠন কেমন?
শালগ্রাম শিলা ছোট্ট কুলের মতো থেকে গরুরগাড়ি র চাকার মতো মাপের হতে পারে। কিংতু সব শিলাই পূজ্য নয়। সাধারণত একটি আমলকির মতো মাপ থেকে, একটি বড় বেলের মতো মাপের সুন্দর সুগঠিত কৃষ্ণ বা মধুর বর্ণ শিলাই পূজ্য। শিলা যেনো ভগ্ন স্ফুটিত বা কর্কশ বা লাল উগ্র বর্ণ না হয়। সেই শিলা যেন সুন্দর ভাবে বসে, তবে সেই শিলা পূজ্য। শিলা যে সবসময় নিটোল গোল হবে এমন নয়, কারণ প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্ট বা গঠিত জিনিস সবসয়ম নিটোল গোল হয়ও না। ঐ যে জীবাশ্মের কথা বলা হয়েছিল, সেটাই হলো শালগ্রাম শিলার চক্র চিহ্ন। চক্র চিহ্নহীন শিলা পূজ্য নয়।
এবার প্রশ্ন ওই চক্র কি ভাবে দেখা যাবে?
চক্র শিলার গায়ে থাকতে পারে আবার ভিতরেও থাকতে পারে। যদি ভিতরে থাকে তবে শিলার গায়ে কোন ছিদ্র বা উন্মুক্ত যায়গা থাকবে যেখান দিয়ে ভিতরের চক্র অর্থাৎ বজ্র কীট বা ফসিলটি দেখা যায়। তবেই সেই শিলা পূজ্য।
চক্র এক বা একাধিক হতে পারে। চক্র সংখ্যা অনুযায়ী শিলার নাম করণ হয়। এক চক্র শিলা প্রায় উনিশ প্রকার। দ্বিচক্র শিলার প্রকার প্রায় আশি প্রকার। এরপরে আরো অনেক প্রকারের আছে। পঁচিশটির বেশি চক্র থাকলে তিঁনি বিশ্বম্ভর হিসাবে চিহ্নিত এবং পূজিত। এর উপরে আর নাম নেই। বিভিন্ন শিলার মধ্যে বঙ্গে দামোদর, শ্রীধর, বামন, নারায়ণ, লক্ষ্মী নারায়ণ, জনার্দন বা লক্ষ্মী জনার্দন, রাজ রাজেশ্বর ইত্যাদি শিলা অধিক প্রচলিত। দুঃখের বিষয় হলো শিলা চেনেন এমন মানুষ চিরকালই অত্যন্ত বিরল। তাই নামে দামোদর হলেও বা নামে জনার্দন হোলেও অনেক শিলাই আসলে শাস্ত্র লক্ষণ অনুযায়ী তা নয়।
মহাপবিত্র মহাদিব্য রত্ন শালিগ্রাম নারায়ণ শিলা :-
শালিগ্রাম নেপালের মুক্তিনাথ এলাকায় পাওয়া গন্ডকী নদীতে গভীরে পাওয়া একটি মহাপবিত্র মহাদিব্য নারায়ণ শিলারত্ন । এইটি মূর্ত প্রতীক ভগবান বিষ্ণুর উপাসনা করা হয়। তেমনি অসাধারণ পবিত্র মহাদিব্য রত্ন শালিগ্রাম এর উপাসক তার সমস্ত প্রচেষ্টায় প্রচুর জ্ঞান, ভাল গুণ, সাহস এবং সাফল্য পান। শালিগ্রাম পবিত্র মহাদিব্য রত্ন শান্তি ও সুখ প্রদান করে। প্রতিটি প্রকৃত শালিগ্রাম মহাদিব্য নারায়ণ শিলারত্ন এর চিহ্ন রয়েছে যা প্রায়ই ভগবান বিষ্ণুর চক্র সুদর্শন চক্রের প্রতিনিধিত্ব করে। বিষ্ণুর দৃশ্যমান এবং প্রাকৃতিক প্রতীক হিসেবে সারা দেশে মন্দির, মঠ এবং গৃহস্থালিতে শালিগ্রাম পাথরের পূজা করা হয়। এই শালিগ্রাম পাথরে স্নান করা জলে চুমুক দেওয়া অনেক ধর্মপ্রাণ হিন্দু পরিবারের জন্য একটি দৈনন্দিন অনুষ্ঠান। শালিগ্রামের এই ক্ষমতা রয়েছে যে ব্যক্তি তার কাছে যে কোনও সংকল্প গ্রহণ করার জন্য অসাধারণ আত্মবিশ্বাস প্রদান করে এবং সে চূড়ান্ত বিজয়ী হয়ে ওঠে। পবিত্র মহাদিব্য শালিগ্রাম নারায়ণ শিলার উপাসক বুদ্ধিমান সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম এবং তার জীবনে প্রচুর শান্তি ও সমৃদ্ধির অভিজ্ঞতা লাভ করে। শালিগ্রামের উপাসক তার সমস্ত চেষ্টায় প্রজ্ঞা, ত্যাগ , বৈরাগ্য , ভক্তি ও উত্তম গুণাবলী, সাহস এবং সাফল্য পান এবং অন্তে পরম বৈকুন্ঠগতি লাভ করেন ও পরম মুক্তিলাভ করেন। ।
পবিত্র মহাদিব্য রত্ন শালিগ্রামশিলা কত রকমের হয় ও কি কি ???
পবিত্র মহাদিব্য রত্ন শালিগ্রামশিলা 20 ধরনের শালিগ্রাম শিলা হয় -এটাই জানা যায়।শালিগ্রাম পবিত্র মহাদিব্য রত্ন ভিতরে চক্র রয়েছে। এগুলি আকার, আকার, রঙ, খোলা (দ্বার), চক্র (প্রাকৃতিক খোদাই), লাইন ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে কয়েকটি নিম্নরূপ:
1. লক্ষ্মীনারায়ণ শালিগ্রাম শিলা: হালকা গা কালচে রঙের, একটি খোলার, চারটি চক্র এবং একটি লাইন।
2. প্রদ্যুম্ন শালিগ্রাম শিলা: ছোট, উপরে একটি চক্র, এবং বাঁকা দিয়ে।
3. অনিরুদ্ধ শালিগ্রাম শিলা: গোলাকার, হালকা হলুদ থেকে হলুদ রঙ, মসৃণ কাচের মতো প্রদর্শনী। শান্তি ও সুখ বয়ে আনে।
4. বাসুদেব শালিগ্রাম শিলা: স্বয়ং কৃষ্ণের পূজা করার সমতুল্য। গোল, চকচকে, একটি খোলার চারপাশে দুটি চক্র। ভক্তদের কাছে তাদের হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আসে।
5. সংক্ষিপ্ত শালিগ্রাম শিলা: দুটি চক্র একে অপরের মুখোমুখি। সামনের দিকে সংকীর্ণ এবং পিছনে বিস্তৃত। ব্রহ্মচারীদের জন্য, এটি জ্ঞান নিয়ে আসে।
6. নরসিংহ শালিগ্রাম শিলা: অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পূজা করা হয়। দুটি চক্র রয়েছে এবং আকৃতি বৈচিত্র্যময়। এই শালগ্রামের ভক্ত হয়ে যান সর্বসঙ্গতিগী (ত্যাগী) এবং জিতেন্দ্রিয়া।
7. লক্ষ্মী নরসিংহ শালিগ্রাম শিলা: নরসিংহ শালিগ্রামের মতো উগ্রা নয়। এই শালিগ্রামটি এইভাবে আনন্দদায়কতার মূর্ত প্রতীক।এটির একটি বিস্তৃত খোলা রয়েছে, দুটি চক্র রয়েছে এবং একটি মালার ধরনও রয়েছে।এটি ভক্তদের শান্তি ও সান্ত্বনা এনে দেয়।
8. হায়গ্রীব শালিগ্রাম শিলা: ঘোড়া দুটি চক্রের মুখোমুখি। এত আকর্ষণীয় চেহারা নয়। বিশেষ করে জ্ঞানের জন্য (শিক্ষা)।
9. সুদর্শন শালিগ্রাম শিলা: একটি চক্রের সাথে একটি সাধারণ রূপ রয়েছে।
10. গদাধরা শালিগ্রাম শিলা: একটি চক্রের সাথে খুব সাধারণ।
11. মধুসূদন শালিগ্রাম শিলা: গা মেঘের রঙ এবং চাকার আকৃতি। একটি বাছুরের পায়ের ছাপের মতো লক্ষণ রয়েছে। খুবই পবিত্র।
12. লক্ষ্মীনারায়ণ শালিগ্রাম শিলা: একটি রেখা মত একটি মালা দিয়ে খোলা। গা মেঘের রং, চারটি চক্র। খুব বিরল এবং বিশেষ। ভক্তদের সকল ইচ্ছা পূরণ করে।
13. লক্ষ্মীজনার্ধন শালিগ্রাম শিলা: একটি রেখা মত কিন্তু মালা ছাড়া, গা মেঘের রং, চারটি চক্র। খুব বিরল এবং বিশেষ। ভক্তদের সকল ইচ্ছা পূরণ করে।
14. বামন শালিগ্রাম শিলা: আকারে ছোট, কালো রঙের হালকা ছায়া, দুচক্র যার কোন খোলার সুযোগ নেই।
15. শ্রীধর শালিগ্রাম শিলা: আকারে ছোট, কালো রঙের হালকা ছায়া, দুচক্র যার কোন খোলার সুযোগ নেই। কিন্তু রেখার মতো মালা দিয়ে। ভক্তদের জন্য শুভকামনা এবং উন্নতি নিয়ে আসে।
16. রঘুনাথ শালিগ্রাম শিলা: দুটি খোলা, চারটি চক্র এবং একটি বাছুরের অনুরূপ চিহ্ন।
17. দামোদর শালিগ্রাম শিলা: তুলনামূলক ভাবে বড়ো , সাধারণত মন্দিরে পাওয়া যায়। দুটি চক্র আছে।
18. রানা রাম শালিগ্রাম শিলা: গোলাকার, মাঝারি আকারের, দুটি চক্রের সাথে, শিশুর চিহ্ন, ধনুক এবং তীর চিহ্ন।
19. রাজরাজেশ্বর শালিগ্রাম: গোলাকার, মাঝারি আকারের, দুটি চক্রের সাথে, শিশুর চিহ্ন, ধনুক এবং তীর চিহ্ন কিন্তু সাতচক্র এবং ছাতার চিহ্ন (ছত্রী) সহ। ভক্তদের কাছে রাজ যোগ এবং রাজা সন্মান এনেছে।
20. অনন্ত শালিগ্রাম শিলা: 14 টি চক্র সহ কালো কালো। শালিগ্রামের সবচেয়ে পবিত্র। খুব দুর্লভ…
ভগবান বিষ্ণু শালিগ্রাম শিলার কী নিয়ম মেনে চলতে হবে?
এটি আপনার গুরু উপদেশ অনুসারে উপাসনা করা উচিত, তবে এটি অবশ্যই ভগবান বিষ্ণু শালিগ্রাম শিলার কোনো উপাসকের উপদেশ নিয়ে পূজা করা উচিত।
এটি আপনার পূজা মণ্ডপে রাখা উচিত, কাঠের পছন্দমতো তৈরি পাত্রে।
আপনি কেবল তখনই ভগবান বিষ্ণু শালিগ্রাম শিলাকে স্নান করতে পারেন যখন আপনি মাথা স্নান করেছেন এবং কোনও ধরণের অশুচিতার সাথে যোগাযোগ না করে পরিষ্কারভাবে ধুয়ে যাওয়া কাপড় পরেছেন।
x
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন